‘বিকল্প’ ধানটিই হতে পারে প্রকৃতির উৎপাতের বিকল্প’

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। আর উদয়াস্ত পরিশ্রম করে এই খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন আমাদের দেশের কৃষকগণ। তাঁরা বীজ সংরক্ষণ, বিনিময়, সঠিক সময়ে বীজ বপন, জমির পরিচর্যা ইত্যাদি কার্যক্রমের সাথে সারাদিন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকেন। ফলে কোন ধানের উৎপাদন কেমন, কোনটাতে পোকা ধরে, কি কারণে ফলনের তারতম্য হয় – এসমস্ত অনেক বিষয় তাঁদের নখদর্পনে।


বেশ কিছু বছর আগেও আমাদের কৃষকগণ নিজস্ব বীজ দিয়েই চাষ করতেন। কিন্তু বর্তমানে উন্নত কৃষিব্যবস্থার মোহে পড়ে কৃষকগণ জমি এবং নিজেদের ক্ষতি করছেন- এটি তাঁরা অনুধাবন করতে পেরেছেন। একদিকে বিভিন্ন কোম্পানির লোভনীয় প্রস্তাব অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে চাহিদা বৃদ্ধি, এসমস্ত কারণে কৃষকগণ স্থানীয় জাতের ধান চাষ হতে কিছুটা সরে আসছিলেন। শুধু কোম্পানির বীজই নয়, চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রকৃতির ভূমিকাও অসামান্য।
লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের সানকিউড়া গ্রামের কৃষকগণ ধান চাষের ক্ষেত্রে তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে সবচে’ বড় সমস্যা ছিল ধানে অতিরিক্ত চিটা। যে কারণে ফলন কম হতো। উন্নত জাত চাষের ফলে ধানে অতিরিক্ত চিটা, উৎপাদন কম, পোকার আক্রমণ বেশি ইত্যাদি সমস্যায় তাঁরা ধান চাষে আশানুরূপ ফলন পাচ্ছেন না। তাছাড়া তাঁদের বাজার নির্ভরশীলতার কারণে স্থানীয় জাতের বীজের সংকট দেখা দিয়েছিল। তাঁরা যখন বুঝতে পারলেন যে এভাবে চাষাবাদ করলে ভবিষ্যতে তাঁদের ধান চাষ করা বন্ধ করে দিতে হবে। তাই তাঁরা স্থানীয় জাতের ধানের বীজ সংগ্রহের জন্য ‘বারসিক’ এ যোগাযোগ করেন। উল্লেখ্য যে এই গ্রামে নিয়মিত যোগাযোগ, গ্রামসভা, কৃষকদের সমস্যা, চাষাবাদ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, সব্জী বীজ বিতরণ, অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর ইত্যাদিতে সহযোগিতা করা হয়েছিল।


গত ২০২২ সালের আমন মৌসুমে সানকিউড়া গ্রামের কয়েকজন কৃষক বারসিক থেকে ৫টি জাতের ধান বীজ সংগ্রহ করেন। জাতগুলো ছিল বিকল্প, সুবাশ, ডি. এস-৪, ডি. এস-২ ও জেসমিন। এগুলোর মধ্যে কেবল মাত্র ‘বিকল্প’ ধানটির ফলন ভালো হওয়া এবং কৃষকদের চাহিদা পূরণ হওয়ায় এলাকা উপযোগি হিসেবে চিহ্নিত হয়্। ‘বিকল্প’ জাতটি চাষ করেন কৃষক মো: ওমায়েদ মিয়া। জমিটি গ্রামের মাঝামাঝি জায়গা ও রাস্তার পাশে থাকায় গ্রামের অনেক কৃষক দেখতে পেতেন এবং ধানের থোড় বের হওয়ার পর ধানের শিষ, গাঁথুনি ইত্যাদি দেখার পর এই ধানের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ জন্মায়। ওমায়েদ মিয়া ১৫ শতাংশ জমিতে এই ধান চাষ করেন। এই জমিটুকুতে প্রায় ৭ মণ ধান উৎপাদিত হয়। ধানের এই রকম ফলন দেখে পরবর্তী বছর কৃষক ওমায়েদ মিয়ার কাছ থেকে এই গ্রামের ৫জন কৃষক ‘বিকল্প’ ধানের বীজ সংগ্রহ করেন।


এভাবেই শুরু হয় ‘বিকল্প’ ধানের চাষাবাদ শুরু। চলতি বছর আমন মৌসুমে সানকিউড়া গ্রামের ১৫জন কৃষক ৯৮কাঠা জমিতে এই ধানের চাষ করেছেন। গত মৌসুমে যে কৃষকগণ ওমায়েদ মিয়ার কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁরাও এবছর অন্যান্য কৃষকদের বীজ সহযোগিতা করেছেন।


চলতি বছর ওমায়েদ মিয়া ১৫ কেজি ধানের বীজ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছেন। এছাড়া প্রায় ৩০শতাংশ জায়গায় বপনকৃত ধানের চারাও বিক্রি করেছেন। তিনি গত আমন মৌসুমে ৫০শতাংশ জায়গায় এই ধান চাষ করে ৩০ মণ ধান পেয়েছেন। এই বছর তিনি ১০ কাঠা (১০০ শতাংশ) জমিতে ‘বিকল্প’ ধান চাষ করেছেন। এই জাতটি চাষ করতে অতিরিক্ত সার, বিষ প্রয়োগ করতে হয়না। খরচের পরিমাণ কম।


কৃষকদের সাথে আলোচনা করে ‘বিকল্প’ ধানটি পছন্দ করার কারণ সম্পর্কে জানা যায়। তাঁদের মধ্য থেকে প্রায় সকলেই বলেন, এই ধানের উৎপাদন বেশি। চিটা হয়না। মূলত চিটা’র সমস্যার জন্যই কৃষকরা তাঁদের চাষকৃত ধান চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন।


ধানে চিটা হওয়া সম্পর্কে প্রবীণ কৃষক মজিবুর ফকির পর্যাপ্ত রোদ না থাকা, অতিরিক্ত বৃষ্টি, বজ্রপাত, ঝড় ইত্যাদি কারণকেই দায়ী করেন। তাঁর মতে, ‘বেশি কোনো কিছুই ভালা না। প্রকৃতির উৎপাতে আমরা ক্ষতির সামনে পড়ছি। কয়েক বছর ধইরাই আমরা ধান চাষে লাভ পাইনা। এই কারণেই আমরা এইরম একটা আলি (বীজ) চাইছিলাম, যাতে ধুরা (চিটা) না অইয়া ফলন ভালা হয়। আমরা পাইছি। এইবার অনেকেই আলি না পাওয়ায় চাষ করতে পারছেনা। আগামীতে তারারেও আলি দেওনের চেষ্টা করবাম, যাতে তারাও কিছুটা লাভবান হয়”।


বর্তমান সময়ে উক্ত গ্রামের কৃষকদের প্রথম পছন্দের ধান ‘বিকল্প’। এই জাতটি পছন্দ করার কারণ হিসেবে চিটা না হওয়া, ফলন বেশি, পোকার আত্রমণ কম, শিষ খাড়া থাকে, নিচু জমিতে ফলন বেশি হয়, চাল সুন্দর, ভাত খেতে সুস্বাদু ইত্যাদি বিষয়কে চিহ্নিত করেন।


কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ‘বিকল্প’ ধানটি। এই ধানটি চাষের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। ভবিষ্যতে অন্যান্য মৌসুমেও এ ধরণের ধান চাষের আগ্রহ প্রকাশ করছেন।


একজন কৃষক যখন তাঁর কৃষিকেন্দ্রিক সমস্যা চিহ্নিত করতে পারেন, তখন সমাধানের পথও তিনিই বের করতে পারেন এবং নিজস্ব পন্থায় সমাধানের ফলাফল হয় স্থায়িত্বশীল। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের কৃষিপ্রতিবেশ ভিন্ন। যে কারণে তাঁদের কৃষিকেন্দ্রিক সমস্যাতেও অমিল। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন, বাজার নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণেই আমাদের কৃষিব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ভিন্ন ভিন্ন কৃষিপ্রতিবেশের কৃষকগণ যদি পরিবর্তনের ইতিবাচক দিকগুলোকে গ্রহণ করে, পরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকার বিকল্প পন্থা খুঁজে বের করে তবেই আমাদের এই দেশ আবারো সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা হবে।

happy wheels 2

Comments