মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘আমরা উপকূলীয় এলাকার মানুষ প্রতিনিয়ত নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে আমাদের টিকে থাকতে হচ্ছে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মানব সৃষ্ট দুর্যোগ বিশেষ করে অপরিকল্পিতভাবে লবণ পানি উত্তোলন, লবণ পানির চিংড়ি ঘেরের প্রভাব বিস্তার, কৃষিজমিতে রাসায়নিক সারের মাত্রারিক্ত ব্যবহারের কারণে বিরূপ প্রতিক্রয়া সৃষ্টি হচ্ছে। আগেকার দিনে আমাদের কৃষি জমিতে এবং বসতভিটায় বছরব্যাপি নানান ধরনের ফসল চাষাবাদ করতাম। প্রতিটি বাড়ি ছিলো কৃষিসমৃদ্ধ। এমন কোন বাড়ি ছিলো না যেখানে ফসল চাষাবাদ হতো না। আর এখন আমাদের জমির মাটির শক্তি হারিয়ে গেছে। আগে যা লাগাতাম তা হতো এখন আর তা হচ্ছেনা। এর সবচেয়ে বড় যে কারণ হলো জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার।’
উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব কালিনগর গ্রামের প্রবীণ কৃষক ননী জোয়ারদার। সম্প্রতি মাঠ পর্যবেক্ষণে কালিনগর গ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্র, ফষল চাষ, প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের সময় উপরোক্ত কথাগুলো বলেন তিনি।
ননী জোয়ারদার জানান, ‘আমাদের গ্রাম সমুদ্রকুলবর্তী হওয়ার পরেও অতীতে বসতভিটায় এবং কৃষি জমিতে নানান ধরনের ফসল চাষাবাদ করতাম এবং তা ভালোই হতো। কারণ তখন এলাকাতে গরু, ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগি ছিলো ভরপুর। জমিতে ব্যবহার করতাম জৈব সার। প্রায় বাড়িতে ছিলো একটি করে গর্ত যেখানে হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, বাড়ির ময়লা আবর্জনা, তরকারীর খোসা যেগুলো পচিয়ে জমিতে সার হিসাবে ব্যবহার করতাম। এখন কৃষি জমি কমে যাওয়া এবং লবণ পানির লোকালয়ে প্রবেশের কারণে প্রাণবৈচিত্র্য বিশেষ করে গরুর পরিমাণ কমে গেছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু এ রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণে আমাদের জমিগুলো যেন বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো আর ফসল উৎপাদন হচ্ছেনা।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন প্রতিবছর ফসল চাষের জন্য জমিতে মণকে মণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে। কিন্তু তাতেও ভালো ফসল উৎপাদন হচ্ছেনা। কারণ এলাকা লবণাক্ততা হয়ে হয়ে গেছে রাসায়নিক সারে তেমনভাবে ফলন পাচ্ছিনা। একদিকে যেমন ভালো ফসল উৎপাদন হচ্ছেনা তেমনিভাবে তৈরিকৃত ফসলের নেই কোন স্বাদ। এখন শুধু খাদ্য খাচ্ছি জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু সুস্থভাবে বাঁচতে পারছিনা। এবছর রাসায়নিক সার ব্যবহার করে আলু চাষ করি সেখানেই আমাদের বড় লোকসানের শিকার হতে হয়েছে। তাই এখন থেকে আগামী কয়েক বছর জমিতে জৈব সার ব্যবহার করবো। যেহেতু এলাকাতে গবাদী পশু কম গোবরের সংকট তাই বাইরে থেকে ক্রয় করে নিয়ে জমিতে ব্যবহার করছি। আমার মতো গ্রামের অনেক কৃষক রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার শুরু করেছে। মাটিকে ভালো রাখার জন্য জৈব সার ব্যবহার করতেই হবে।’
কৃষাণী চন্দনা মন্ডল বলেন, ‘আমার গরু নেই। আমার ১৫টি ছাগল, ১০টি মুরগি, ৭টি হাঁস আছে। ছাগল ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা বাড়িতে গর্ত করে রেখে দিয়েছি। এছাড়াও গর্তে বাড়ির ময়লা আবর্জনা, তরকারীর খোসা রেখে দিই। এগুলো পচিয়ে সার তৈরি করে ক্ষেতে ব্যবহার করি। পাশাপাশি ১৫০-২০০ ঝুড়ি গোবর ক্রয় করি। এভাবে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আমরা এর বিরূপ প্রভাব থেকে বের হতে চাই। তাছাড়া জৈব সার ব্যবহারের অনেক সুবিধা এখানে যেমন গাছগুলো সতেজ সুন্দর হয়, ক্ষেতে লবণ কম ওঠে, ফসলের স্বাদ বেশি, সবজি ফসলের বাজার মুল্যও বেশি। আমাদের কৃষিকে বাঁচাতে আমাদের সকলের এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। ’
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল লবণাক্ততা। যার প্রভাবে এখানে যেমন কৃষিজমি কমছে তেমনি কমছে প্রাণবৈচিত্র্য। সাথে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণে মাটির স্বাস্থ্যও খারাপ হচ্ছে। জমিতে ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। যার কারণে ফসল উৎপাদনের জন্য নানান ধরনের উদ্যোগ ও কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। তার মধ্যে মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য জৈব সারের ব্যবহার অন্যতম।