উপকূলীয় সৌন্দর্য্য ও সুন্দরবন ঘেঁষা মানুষের গল্পকথা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে ঘুরে এসে মানিকগঞ্জ হতে নজরুল ইসলাম
গত ৫-৮ জুন, ২০১৭ অফিসের একটি কর্মশালায় যোগ দিতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় যাওয়া হয়। অনেক দিনের বাসনা ছিল সুন্দরবন এবং উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শণ করার। দেশের অনেক এলাকা দেখা হলেও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় দেখা হয়নি। কর্মশালা, মাঠ পরিদর্শন ও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আলোকে আমার উপলব্ধির কথা শোনাতে চাই আজ।
জলবায়ু পরিবর্তন এর প্রভাব বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিলেও দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান সে বিষয়ে আমার অন্তত কোন সন্দেহ নেই। প্রকৃতিগতভাবেই নানাবিধ কারণে এই এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকায় রয়েছে প্রতিকূলতা। পাশাপাশি, মনুষ্যসৃষ্ট নানা কর্মকান্ত এবং সিদ্ধান্তের কারণে প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এই এলাকায় ৪টি কারণে এই এলাকাটি দিন দিন ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। প্রথমত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দ্বিতীয়ত নির্বিচারে সুন্দরবন তথা প্রকৃতি ধ্বংস করায় সেই দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা হ্রাস। তৃতীয়ত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করায় লবণাক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে এবং এর পরিমাণ বাড়ছে এবং চর্তুথত, বাণিজ্যিকভাবে যথেচ্ছভাবে লবণাক্ত পানির মাছ চাষ।
বারসিক এর শ্যামনগর রিসোর্স সেন্টারের এর গবেষণা অনুযায়ী সাতক্ষীরা জেলার ২টি উপজেলায় ২০০৫ সাল হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার একর। একই রকম চিত্র অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও। সেই ধারাবাহিতায় সমগ্র জেলায় এক দশকে লোনা পানির বাগদা চিংড়ি চাষের জমি বেড়েছে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর; যা মূলত কৃষিকাজে ব্যবহৃত হতো। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে হয়তো কৃষিজমি অবশিষ্টই থাকবে না।
এই এলাকার সহকর্মী রামপ্রসাদ জোয়ারর্দার বলেন, “এই অঞ্চলে সিডর ও আইলার মতো ঘুর্ণিঝড়ে প্রকৃতি এবং সংস্কৃতিতে অনেকগুলো ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। সেই ক্ষতগুলো এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। যদিও এই অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করে যাচ্ছে মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টির জন্য বিশেষ করে বনজীবী, মৌয়াল, মুন্ডা, হালদার, আদিবাসীসহ পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বারসিকও।”
চুনা নদী দিয়ে প্রবাহিত দুইদিকে বন। আর বনের অপরূপ প্রকৃতির দৃশ্য দিনে দুইবার জোয়ার ভাটায় প্রকৃতি প্রেমীদেরকে করে অবিভূত। অন্যদিকে মাছ শিকার হওয়া না হওয়ার উপর জীবিকা নির্ভর করে জেলে পরিবারগুলো। বুড়িগোয়ালীনি বনের গহীন খালের ভিতর দিয়ে মাছ ধরছে নারায়ণ চন্দ্র রাজবংশী ও তার স্ত্রী রেবতী রাজবংশী। রেবতি বলেন, “সারদিন আজকে যে মাছ ধরেছি তা মাত্র ৮০ টাকায় বিক্রি করেছি। তাতে কি আর পেট চলে। তাই আবার আসলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে- এখন চলে যাবো। সন্ধ্যায় বনের ভিতর যাই না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা বনকে পূজা করি। তাই যখন সন্ধ্যার আযান হয় তখন কাজ বন্ধ রাখি। নারায়ন হালদার বলেন, “বনের উপর যারা জীবিকা নির্বাহ করেন তারা বনকে পূজা করেন। সকল ধর্মের মানুষ সমানভাবে বনকে পূজা করেন।”
দূর্যোগ এর সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার জন্য সাশ্রয়ী জ্বালানি এই অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। চারণভূমি কম থাকায় গবাদি পশুর সংখ্যা কম। তারপরও গোবরে লাঠি, মুঠা ও ঘসির চাহিদা রয়েছে। সারাদেশে যখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ও জ্বালনি সংকট মোকাবেলায় গবেষণা চলছে; ঠিক তখনই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার তালবাড়িয়া গ্রামের ময়না রাণী মন্ডল আবিষ্কার করলেন নতুন আঙ্গিকে তার নিজস্ব কায়দায় ব্যয় সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব উন্নত চুলা। কার্বন নিঃসরন রোধে এই চুলা সারা দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে ছড়িয়ে দেয়া উচিত।
মুগ্ধ হয়েছি সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম নামের একটি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠনকে দেখে। যারা ২০০৯ সাল হতে নিজেদের এলাকার প্রকৃতি ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বহুমুখী কাজ করে আসছে। বিশেষত তাদের নেতৃত্বে সামাজিক বনায়ন কর্মসুচি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
উজ্জীবিত আর আনন্দিত হয়েছি দেশীয় জাতের সবজি চাষ ও সবজি চাহিদা পূরণের জন্য বুড়িগোয়ালীনি আশ্রয় প্রকল্পে বারসিক এর সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে সবজি পাড়া। এই ব্যারাকের বাসিন্দা সন্তোষ মন্ডল, সুহিত চন্দ্র সরদার, নীলকান্ত মুন্ডা ও কৌশলীনি মুন্ডাদের সাথে কথা বলে তাদের সংগ্রাম আর সফলতার হাজারো গল্প আন্দলিত করেছে। এই প্রতিকূল পরিবেশেও তারা স্বল্প পরিমাণ জমিকে কাজে লাগিয়ে সারাবছর নিজেদের উৎপাদিত সবজি দিয়ে পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হন। তাদের ভাষায়, “আমাদের এখন সবজির অভাব নেই, ভাতের অভাব নেই। তবে অভাব আছে খাবার পানির। অনেক দূর হতে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়।” সুহিত সরদার বলেন, “এখানে ধান হয়না বিধায় আমরা অন্য জেলায় গিয়ে ধান কাটি। তাতে যে ধান পাই তাতে বছরে আট মাসের খোরাক হয়ে যায়। আর বাকি চার মাস মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি। এভাবে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে আমরা বেঁচে আছি।”
দেশের অন্যত্র জনসংখা বাড়লেও জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলে গত এক দশকে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে। এখানে দারিদ্র্যের হার বেশি। উপকূলীয় বেঁড়িবাধ ভেঙে কৃষিজমিতে লবণপানি প্রবেশ করলেও প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং প্রভাবশালী চিংড়ি চাষীরা বাঁধ কেটে দিয়ে লোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করছেন। এভাবে চিংড়ি চাষ অব্যাহত থাকলে কারো জন্যই সুফল বয়ে আনবে না।
লবণাক্ততার কারণে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য, পরিবেশ, কৃষি ও মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। গঙ্গার পানির উপর নির্ভরশীল এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলো প্রায় মরে গেছে। লবণাক্ততা কমাতে হলে উজান হতে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে, বন্ধ করতে হবে সমুদ্রের লবণ পানি আসাও। গঙ্গা ও তিস্তার মতো আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি প্রতিবেশী দেশ যথেচ্ছভাবে আটকে রাখার ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা আরো বেশি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মূখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল বেশ সমৃদ্ধ প্রকৃতি এবং সংস্কৃতিতে। এই এলাকার টেকসই উন্নয়ন জন্য সম্মিলিতভাবে আমাদের অনেকগুলো কাজ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে শুকিয়ে যাওয়া নদীগুলো খনন করে নাব্যতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের সাথে ন্যায্য হিস্যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তৎপরতা ও দেন-দরবার বাড়াতে হবে। এই এলাকার উপযোগি লবণ সহনীয় বিভিন্ন জাতের ধানসহ অন্যান্য ফসল এর জাত নির্বাচন, উন্নয়ন এবং উৎপাদন করতে হবে। সকল কৃষককে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে কৃষি এবং মৎস্য চাষের সহঅবস্থানে নিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়নে গতি ক্রমবর্ধমান হলেও এই এলাকার গরিব মানুষের ভাগ্যের তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। এই এলাকার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই এলাকার প্রান্তিক জনগেষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসা অসম্ভব। লবণাক্ত পানির মাছ আমাদের দেশের জন্য আর্থিক সমৃদ্ধি বয়ে আনলেও এই এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষেত্রে একটি বিপর্যয় ডেকে নিয়ে এসেছে। তাই অবশ্যই মাছ চাষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে মাছ চাষের একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন থাকতে হবে এবং সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা পুঁজিপতিদের স্বার্থে সুন্দরবনসহ এই এলাকার স্বাতন্ত্র্য প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা যাবে না।