মানুষের নদী নির্ভরশীলতা
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায় প্রায় সকল বড় বড় মানবসভ্যতা গড়ে ওঠেছিল নদী তীরে। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নগর, বন্দর, শহর, গ্রাম, জেলেপাড়া, বাণিজ্যকেন্দ, প্রভৃতি। এই নদীকে ঘিরেই ছিল আদিকালের যাতাযাতের সকল ব্যবস্থা। জাহাজে, নৌকায় চড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত মানুষ ঘুরে বেড়িয়েছে। কৃষি, মৎস্য, জেলেদের পেশা এবং সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষের নিত্যদিনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ সকল কিছুর একমাত্র উৎস ছিল নদী। নদী আজ দখল, দূষণ আর ভরাটের প্রতিযোগিতায় বিপন্ন; অনেকাংশে বিলুপ্ত।
নিকট অতীতেও নেত্রকোনা জেলায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো ৫৮টি ছোট বড় নদী। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে এই এলাকার মানুষের জীবন, পেশা, কৃষি, ব্যবসা, খাদ্য-পুষ্টি। নদী ছিল এই এলাকার সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। নদীই ছিলো মানুষের প্রাণ।
কত বাহারি নামের নদীই না ছিলো নেত্রকোনার ভুমিতে। ধনু, ধলাই, গুনাই, ঘোড়াউতরা, পিয়াইন, মগড়া, কংস, সাইডুলি, পাঠেশ্বরী, তুষাই, মহাদেও, গণেশ্বরী, নাগঢড়া, কালমগড়া, বিষনাই, ভোগাই কংস, উবদাখালী, মরাসুরমা, পিয়াং,পাটকুড়া,রাজরাজেশ্বরী, লাউয়ারি, কালিহর, সাপমারা, বেতাই, খারছা, চেন্নাই, হলোলিয়া, বন্নী, বয়রাহালা, বালই,চেলাই, গন্টবতী, বালিয়া, মঙ্গেশ্বরী,রাজাখালি,বৌলাই, বিষনাইল, ধনাইখালি, লারখালি, গোলামখালি, রাঙ্গাধাইর, কাউনাই, খরপাই, আতরখালি, দিংঘানা, চেল্লাখালি, দেওদিয়া, মারিসি, মলিজি, ভূগাই, নিতাই, খানিগাঙ, শলাখালি,সোয়াই, মাদল মরানদী, বালচ, প্রভৃতি। বর্তমানে ৭ থেকে ৮ টি নদী ছাড়া বাকী নদীগুলো বিপন্ন; কোন কোনটা বিলুপ্ত। মরাখালে পরিণত হয়েেেছ নদীগুলো। যে কারণে বর্তমান সময়ে এসে নদীর নামের শেষে খালি শব্দ যুক্ত হয়েছে।
নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছিল হাট-বাজার, শহর, বাণিজ্যকেন্দ্র। একমাত্র মগড়া নদীর তীরে ঘেঁষেই ছিলো নেত্রকোনা শহর, লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার, কোনাপাড়া বাজার, নাজিরগঞ্জ বাজার, দেওয়ানের বাজার, জয়বাংলাবাজার। সুমেশ্বর নদীর তীরে দূর্গাপুর উপজেলা, আটপাড়া উপজেলা সদর ও ব্রুজের বাজার, রাজরাজেশ্বরী নদীর তীরে কেন্দুয়া উপজেলা সদর। সাইডুলি ও পাটকুড়া নদীর তীরে বাণিজ্য কেন্দ্র গোগবাজার, নওয়াপাড়া বাজার। বালই নদীর তীরে পদ্মশ্রী বাজার, ধনু নদীর তীরে লেপসিয়া বাজার। নেত্রকোনা জেলার উপজেলা সদর ও বড়বড় হাটবাজারগুলো নদীর তীরেই গড়ে উঠে। যাতাযাতের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের সুবিধার জন্য নদী তীরে গড়ে ওঠে এসব জনপদ ও হাট-বাজার। নদী পথে বেপারী নৌকা দিয়ে ব্যবসা চলতো- ধানপাটের, লাকড়ীর, কাঠের, বাঁশের, মাছের ।
নদীকে কেন্দ্র করে চলতো কৃষকের কৃষি কাজ। এ অঞ্চলের খাদ্য যোদ্ধারা বন্যা, খরা, বজ্রপাতসহ প্রতিকুল পরিবেশ, আফাল, পাহাড়ি ঢল, রোগবালাইয়ের সাথে যুদ্ধ করে ঘরে তুলতো খাদ্যসম্পদ। নদী থেকে পানি তুলে সেচ দিয়ে চলতো কৃষি কাজ। বর্তমানে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় নেত্রকোনা অঞ্চলের কৃষিকেরা সেচের পানিরজন্য সম্পুর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মাটির নীচের পানির উপর। অধিক ফলন ও খাদ্যনিরাপত্তার নামে বাহিরের প্রযুক্তির ব্যবহার করে তুলছে মাটির নীচের পানি।
নদী আমাদের অস্তিত্ত্বের অংশ। নদী আমাদের নান্দনিকতার উৎস। নদীর আত্মহনন বা হত্যা দিয়ে আমরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সচল ধারাকে অবলুপ্ত করতে চাই না। সভ্যতা প্রবহমান; সংস্কৃতি চলমান ধারায় পরিবর্তনের অগ্রদূত। নদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধানতম ধারক ও বাহক। নদীকেন্দ্রিক জীবন প্রবাহের এ ধারাকে সজীব ও জীবন নির্ভর করতে হবে।