প্রান্তিক নারীদের জ্বালানি সংগ্রাম
রাজশাহী থেকে জাহিদ আলী
মানুষের মূল মানবিক চাহিদা ছয়টির মধ্যে খাদ্য একটি অন্যতম চাহিদা। এই খাদ্য খাবার উপযোগী করতে যেসব অনুষঙ্গ প্রয়োজন হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বালানি। জ্বালানি ব্যবহার করেই প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত শস্য ও সবজি খাবার উপযোগী হয়। আবার জ্বালানি প্রাপ্তির সহজলভ্যতা আর্থিক স্বচ্ছলতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। যে মানুষ শহরে বাস করে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে তার মতো গ্রামের মানুষও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে। সরকার বার্ষিক বাজেটে সকল মানুষের জন্য বাজেট ঘোষণা করলেও নাগরিক সুযোগ ও সুবিধা ভৌগলিকভাবে শহরে বাস করা মানুষেরাই বেশি পায়।
শহরে ৪ থেকে ৫ সদস্যের একটি পরিবার রান্নার কাজে ৮০০-৯০০ টাকার গ্যাস ব্যবহার করলেও শহরতলি বা গ্রামে একটি পরিবার মাসে ৫ থেকে ৬ মণ খড়ি ব্যবহার করে। টাকার হিসেবে তা প্রায় ১২৫০ থেকে ১৫০০ টাকা। অন্যদিকে গ্রামে যেসব পরিবারে গরুর সহজলভ্যতা আছে সেখানে পরিবারে জ্বালানি দায়িত্ব অবধারিতভাবে পরিবারে নারীর উপরে পড়ে। পরিবারে অর্থনৈতিকভাবে মন্দাভাব থাকলে নারীর কাজ শুধু নিজ পরিবারের জ্বালানি জোগাড় করেই শেষ হয় না। তাকে সেই জ্বালানি বিক্রি করে পরিবারে আর্থিক চাহিদা পূরণ করে হয়।
বরেন্দ্র অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের পর প্রতিটি বাড়ির সামনে (যেসব পরিবারে গরুর সহজলভ্যতা রয়েছে) গরুর গোবরের তৈরি নুন্দা, লাকড়ি, ঘুটা শুকানো ও মজুদ রাখার দৃশ্য দেখা যায়। নিম্ন আয়ের পরিবারে যার ২ থেকে ৩টা গরু রয়েছে তারা বেশিরভাগই নুন্দা তৈরি করে বিক্রি করেন। গোদাগাড়ী উপজেলা মাটিকাটা ইউনিয়নের এই রকম একটি পরিবারের গৃহিনী ইসমত আরো জানান, “আামার পরিবারে ২টি গাই ও ২টি বাছুর আছে, এগুলো থেকে যে গোবর পায় তা দিয়ে নিজ পরিবারে চাহিদা শেষে নুন্দা তৈরি করে মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার বিক্রি করি। তিনি আরো জানান, এলাকায় বিক্রি করতে সমস্যা হয় না গ্রামের মানুষ এক একটা নুন্দা ২ টাকা দরে কিনে নেয় আবার যারা মাটির হাড়ি তৈরি করে তারা বেশিরভাগ আমার কাছে থেকে নুন্দা কিনে নিয়ে যায়।”
এ প্রসঙ্গে গোগ্রাম ইউপি’র নাজমা বেগম জানান, “আমাদের গ্রামে অনেক পরিবারেই নুন্দা তৈরি করে বিক্রি করে, গ্রামের মানুষ ছাড়াও চায়ের স্টলে নুন্দা ভালো বিক্রি হয়, গ্রামে এক মণ নুন্দা ১২০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
দেওপাড়া ইউপি’র আদিবাসী গ্রামগুলোতে জ্বালানি সংগ্রহের প্রক্রিয়াটা কিছু অন্যরকম। গ্রামে আদিবাসী নারী শ্রমিকরা বেশিরভাগই জমিতে কাজ করেন। তারা জমিতে শুলি বা জিন চুক্তিতে কাজ করেন। ১০০ কেজি ধান বা গম কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াবাবদ শ্রমিক পান ২০ কেজি। ধান কাটা বা গম ঝাড়াইয়ের পর যে খড় থাকে তা কৃষাণীরা জ্বালানি বাবদ সংগ্রহ করেন। এ প্রসঙ্গে কৃষাণী দিপালী এক্কা জানান, “জমির ফসল গৃহস্থের বাড়ির কাছে থাকলে এর খড় তারা নিজেরাই ব্যবহার করে তবে ফসল দুরে হলে তারা আমাদের দিয়ে দেয়। আমরা এগুলো জ্বালানি কাজে ব্যবহার ও সংরক্ষণ করি।”
আরো একজন কৃষাণী ফুলনদেবী মিনস জানান, “ধান কাটার পর যে লাড়া পড়ে থাকে সেগুলো আমরা সংগ্রহ করি। কাঁচা অবস্থায় লাড়া কেটে সংগ্রহ করতে হয়, জমি শুকিয়ে গেলে লাড়া টান দিলেই উঠে আসে। তিনি আরো জানান, লাড়া সংগ্রহ এখন আগের চেয়ে অনেক কষ্টের, আমি নিজে জমিতে লাড়া না কাটলে অন্যজন জমি থেকে ঠিক কেটে নিবে। তাই পরিবারের রান্নার জন্য কষ্ট হলেও তা সংগ্রহ করতে হয়।”
গ্রামে রান্নার কাজে জ্বালানির যোগান যেন নারীরাই করবে। দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজটি নারীরা করে যাচ্ছেন। এর বিনিময়ে তারা কখনও পান তাদের কাজের স্বীকৃতি। পুরুষ শাষিত সমাজে নারীরা পাবে তার কাজের যোগ্য সম্মান এটাই তাদের কামনা।