আর কতদিন বলো সইবো…
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
যখন ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছে, পাখিদের ঘুম ভেঙেছে। কিচিরমিচির শব্দ করে তারা নীড় ছেড়ে পাখা মেলেছে খাবারের সন্ধানে। রাস্তার ধারের নেড়ি কুকুরটাও চমকে উঠেছে পাখির ডাকে। এই বুঝি সকাল হলো! আমাকেও তো বেরিয়ে পড়তে হবে। দিনমজুর থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা-সকলেরই সময় হয়েছে ঘুম থেকে উঠার। ধনী ব্যক্তিরা স্বপ্ন দেখছে আজ কোথায় কি অনুষ্ঠান আছে, যেখানে আমন্ত্রিতদের তালিকায় তাদের নাম আছে। আর নিম্ন আয়ের মানুষেরা ভাবছে যুদ্ধে যাবার জন্য আর একটি দিনের শুরু হলো। উদয়াস্ত পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে, দিনের রোজগারে অভাব পূরণের আপ্রাণ চেষ্টা করে। তবুও তাঁদের কাজ করার সামর্থ্য আছে। কিন্তু সহায় সম্বলহীন, বয়সের ভারে ন্যুজ, চলনে অক্ষম মানুষদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। যাদের উপার্জন করার কেউ নেই, বা নিজেও পারেন না সেই সমস্ত প্রবীণ ব্যক্তিদের ভরসা ভাতা প্রাপ্তির কিছু টাকা। সে টাকাও প্রতি তিন মাস অন্তর পাওয়া যায়।
যেদিন বাড়ির কারো মোবাইলে মেসেজ পাওয়া যায় বা এলাকার মেম্বার গিয়ে খবর দেন অমুক দিন শহরের ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনতে হবে, সেদিন থেকেই জবেদা আক্তারের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার মৌগাতি গ্রামে। জাতীয় পরিচয়ত্র অনুযায়ী বয়স ৮২ বছর। টাকা তোলার আগের রাতে চারটে ভাত একটু বেশি করেই ফুটিয়ে রাখেন। কারণ পরের দিন শহরে যেতে হবে। টাকা তোলার লাইনে দাঁড়ালে কখন যে তাঁর ডাক পড়বে সে ঠিক নেই। তিনি আবার ভাত না খেয়ে থাকতে পারেন না। গ্যাস্ট্রিক এর ব্যারাম আছে কি না !
ভোর হওয়ার সাথে সাথে পান্তা ভাত কটা কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ ডলে খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। কোনোদিন তাঁর সফর সঙ্গী হয় ছোট মেয়ে। আবার কোনোদিন পাড়ার কোনো নাতি বা ভাসুরের ছেলে। তাঁদের সহায়তায় এক হাতে লাঠি ভর করে আল্লার নাম নিয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ান। দু’ পায়ের উপর এখন আর কোনো ভরসা নেই। যে কারণে তিনি এক হাতে লাঠি তুলে নিয়েছেন। লাঠি আর কোনো সহায়তাকারীর হাতই তাঁর চলার অবলম্বন।
স্বামী মারা গেছেন ২০০৫ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঘরের চাল ভেঙে পড়েছিল তাঁর মাথায়। ঝড় থামার পর লাশটি পাওয়া গিয়েছিল। এরপর থেকে জবেদা আক্তারের দুঃখের দিন শুরু হয়। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করছিলেন। ছেলেরা এক সময় বড় হয়ে নিজের মতো করে জীবন কাটাতে শুরু করে। আর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। এখন বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। ছেলেরা মাঝে মধ্যে খোঁজ খবর নেয় ঠিকই। কিন্তু ভরণপোষণের ভার কেউ নেয় না।
বয়ষ্ক ভাতা থেকে পাওয়া পনেরো’শ টাকার অধিকাংশটাই খরচ হয়ে যায় ওষুধ কিনতে। খাবার খরচের বেশির ভাগটাই বহন করে তাঁর ছোট মেয়ে। ক’টা ভাতই বা খান তিনি ? বয়স এবং অসুস্থতার কারণে পেট ভরে খেতেও পারেন না। এভাবেই তাঁর দিন কাটছে। মাঝে মাঝে রাগ হলে আল্লাহকেও বকাবকি করেন। কেন তিনি এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁকে। যার কেউ নেই, কোনো সম্পদও নেই তার কেনো বেঁচে থাকতে হবে ?
মৌগাতি থেকে আসার পথে কখনো পায়ে হেঁটে আবার কখনো অটোতে চড়ে নেত্রকোনা শহরে আসতে হয়। এখানে এসেও শান্তি নেই। ব্যাংকের সামনে অনেক লোকের ভিড়। বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর পর্যন্ত জায়গা থাকে না। এখানে শুধু তিনি একা নন, তাঁর মতো আরো অনেক জবেদা আছে এই শহরে, গ্রামে। তাঁদেরও একই অবস্থা। রাস্তায় বসে তিনি ভাবেন এখানে যদি একটা চেয়ার থাকতো, তবে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসতে পারতাম! যদি মাথার উপরে একটা পাখা ঘুরতো! গরমে, ক্লান্তিতে চোখের পাতা দুটি লেগে আসে। সেই কোন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন, কখন বাড়ি গিয়ে একটু বিছানায় বসবেন এই ভাবনায় তিনি অস্থির।
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, টিপসই দিয়ে টাকা তোলা এসব করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে যায় তিনি খেয়াল করতে পারেন না। টাকা ক’টা হাতে পেয়ে ভাবেন আজকের মতো ঝামেলা শেষ হলো। বাড়িতে যাওয়ার আগে গ্যাস্ট্রিকের অষুধ কিনে নিতে হবে। সাথে একটা ব্যথা কমানোর ট্যাবলেট। ব্যথার ওষুধটা না খেলে আর পরের দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবেন না। এই সব চিন্তা করতে করতে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। মেয়ের হাত ধরে দিন শেষে বাড়িতে যাবার প্রস্তুতি নেন জবেদা আক্তার।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করার লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে বয়ষ্ক ভাতা কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। মূলত যারা দুঃস্থ, স্বল্প উপার্জনক্ষম এবং উপার্জনে অক্ষম প্রবীণ ব্যক্তিদের সহায়তায় এই অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
সবই ঠিক আছে কিন্তু জবেদা আক্তারের মতো প্রবীণ ব্যক্তিদের পক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহের জন্য দূর পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়া কি সহজ বিষয়? চলাচলের রাস্তায় কত ধরণের সমস্যা বা বিপদ হতে পারে। সেদিকে কে নজর দিবে? বর্তমান সময়ের আধুনিক যুগে কত কিছু ঘরে বসেই পাওয়া যায়। বয়ষ্ক ভাতার টাকাটা কি কোনো আধুনিক উপায়ে প্রবীণ ব্যক্তিদের হাতে সরকার পৌঁছে দিতে পারেনা? তাহলে জবেদা আক্তারসহ অনেক প্রবীণ ব্যক্তির কষ্ট লাঘব হতো। তাছাড়া টাকা উত্তোলনের স্থানে বসার ব্যবস্থা থাকলেও প্রবীণ ব্যক্তিগণ একটু বোধহয় আরাম পেতেন। যারা বাড়িতে থেকেই চলাফেরা করতে পারেন না, তাঁরা কিভাবে এই যুদ্ধ জয় করবেন?