সুস্থ পানিব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে
সিলভানুস লামিন
পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ হচ্ছে পানি। বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে উপরিভাগের পানি তথা নদীনালা, খাল, বিল, নালা, ডোবা, পুকুর, ঝর্ণা এবং ভূগর্ভস্থ পানি। বলা হয়, পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ২.৫ ভাগ মিষ্টি এবং বাকি ৯৭.৫ ভাগ পানি হচ্ছে লবণাক্ত। এছাড়া মিষ্টি পানির মধ্যে মাত্র ০.০২৫ ভাগ পানি হচ্ছে পানযোগ্য। ফলে কৃষির জন্য, গৃহস্থালী কাজের জন্য, শিল্পকারখানার জন্য এবং মানুষের পানের জন্য আজ সর্বত্রই পানি সঙ্কট অনুভূত হচ্ছে। অথচ বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ পানির আধারগুলোর দূষণ, দখল এবং ভরাট যেভাবে করা হচ্ছে তাতে সবার মনে হতে বাধ্য হবে যে, পৃথিবীতে বিশুদ্ধ পানির উৎস অসংখ্য! হিন্দুদের কাছে পবিত্র নদী বলে খ্যাত গঙ্গার পানিতে সহনীয় মাত্রার চাইতে অনেক বেশি আর্সেনিক পাওয়া তো গেছেই সাথে সাথে এই নদীর তীরবর্তী এলাকায় অসংখ্য গাছপালা নিধন এবং অবকাঠামো নির্মাণের কারণে এই নদীর পানি যোগানকারী হিমালয়ের হিমবাহ গলে যাওয়ায় পানি সঙ্কট এবং ভাটি অঞ্চলে ইতিমধ্যে খরা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণের জন্য ৯৫% ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে। ফলে উত্তর আমেরিকার সবচে’ বৃহৎ বিশুদ্ধ পানির উৎস Ogallalaর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় বার্ষিক ১২ বিলিয়ন কিউবেক মিটার পানি হারাচ্ছে। আমাদের দেশে বুড়িঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষা নদীসহ অসংখ্য বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো দূষণ, ভরাট এবং দখলের কারণে ধীরে ধীরে এগুলো ধবংস হতে যাচ্ছে।
উপরোন্তু রাসায়নিক কৃষি, উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের কারণে লবণাক্ততা, দেশের অসংখ্য জেলায় আর্সেনিক দূষণ, নদীর তীরবর্তী ও নদী পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদীর গর্ভে শিল্পকারখানার বর্জ্যসহ অন্যান্য মানব সৃষ্ট বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে আজ বাংলাদেশেও পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বল্প বৃষ্টিপাত, বৃষ্টিহীনতা এবং আকস্মিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সামগ্রিকভাবেই বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্ব উষ্ণতার কারণে হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়ায় আগামী ২৩৫০ সালে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, ইন্দুস, সালয়িন এবং Yellow নদীগুলো বিলুপ্ত হতে পারে।
জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন (২০০৬) অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বর্তমানে ১.১ বিলিয়ন মানুষ বিশুদ্ধ পানির পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার নেই এবং ২.২ বিলিয়ন মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই, যা তাদের দরিদ্র পরিস্থিতিকে আরও নাজকু করে তুলেছে। অন্যদিকে বিশ্বে ১.৮ বিলিয়ন শিশু দূষিত পানি পানজনিত কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং পানিজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে সারাবিশ্বে ৪৪৩ মিলিয়ন স্কুল দিন নষ্ট হয়েছে। বিশ্বে পানি সঙ্কটের গভীর প্রভাব পড়েছে নারীর ওপর। কারণ সুপেয় পানি আহরণের জন্য গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি নারীকে দৈনিক কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। এছাড়া দূষিত পানি পানের কারণে কিংবা গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের কারণে নারীরা নানান পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে ইউনিসেফের (২০০৫) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিবছর ১.৪ মিলিয়ন শিশু বিশুদ্ধ পানির অভাবে মারা যেতে পারে। মূলত দরিদ্ররাই এসব পানি সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি।
জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি তিনজন পানি সঙ্কটাপন্ন মানুষের মধ্যে দু’জন দৈনিক মাত্র ২ মার্কিন ডলারের চেয়ে কম অর্থ দিয়ে দিনাতিপাত করে যার মধ্যে তিনজন পানি সঙ্কটাপন্ন মধ্যে একজন দৈনিক এক ডলার মার্কিন ডলার চেয়েও কম অর্থ দিয়ে দিনাতিপাত করে। অন্যদিকে এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বে ৬৬০ মিলিয়ন মানুষ কোন ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই এবং এই সংখ্যার মানুষগুলো দৈনিক ২ মার্কিন ডলারের চেয়েও কম অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থ্যাৎ পানি সঙ্কটে সবচে’ বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে দরিদ্র মানুষেরাই। এ মানুষগুলোই পানিবাহিত নানান রোগে আক্রান্ত, প্রতিবছর তাদের মৃত্যুর হার বেশি এবং পানিকেন্দ্রিক যত ধরনের সমস্যা তারাই বেশি সন্মূখীন হচ্ছে।
অন্যদিকে পানি সঙ্কটের মূলে অনেকে পানি সম্পদের বা আধারের স্বল্পতার তুলনায় পানি অব্যবস্থাপনাকে দায়ি করেছেন। সুপেয় পানি সম্পদের উৎসগুলোকে দূষণ পানি সমস্যা সৃষ্টি করছে তা সত্য; তবে পানি সম্পদের অপ্রতুলতা বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই যে বিশ্বব্যাপী সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে তা কিন্তু নয় বরং অনেকের মতে, পানি অব্যবস্থানাই এই সঙ্কটের মূল কারণ। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১২% মানুষ ৮৫% ভাগ সুপেয় পানি ব্যবহার করে এবং ১২% মানুষ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে বাস করে না। পানি সঙ্কটের মূল কারণই হচ্ছে ক্ষমতা, দারিদ্র্যতা, অসাম্যতা; সুপেয় পানির আধারগুলোর স্বল্পতা নয়। বিশ্বের ১.৮ বিলিয়ন মানুষ দৈনিক ২০ লিটারের কম পানি ব্যবহার করে অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের মানুষ দৈনিক ৫০ লিটার পানি ব্যবহার করে শুধুমাত্র টয়লেটের ফ্ল্যাশ করার জন্য। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ দৈনিক ৬০০ লিটার পানি ব্যবহার করে। উন্নয়নশীল এবং তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরাই সবচে’ বেশি পানি সঙ্কটে ভুগলেও কোকাকোলার মতো বহুজাতিক কোম্পানির পানীয় উৎপাদনের জন্য তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশের পানি সম্পদ ব্যবহার করে। তাই তৃতীয় বিশ্ব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুপেয় পানি সঙ্কট মোকাবিলায় সুপেয় পানির উৎস রক্ষার পাশাপাশি সুষ্ঠু পানিব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।