একজন অপরাজিতার গল্প
মানিকগঞ্জ থেকে কমল চন্দ্র দত্ত
জন্মের পর থেকেই প্রত্যেককেই বেঁচে থাকার তাগিদে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বড় হতে হয়। এমনই একজন নারী যাকে ছোটবেলা থেকেই অনেক সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছে। তিনি মানিকগঞ্জ পৌরসভার উচুটিয়া গ্রামের লৌহকার পাড়ার চম্পা রাণী কর্মকার (৩৮)।
পৌরসভাধীন গ্রাম হলেও যাতায়াত ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়; ভাঙা বাঁশের ব্রিজ পেরিয়ে এই গ্রামে যেতে হয়। এই পাড়ার চম্পা রাণী কর্মকার ও স্বামী পরম চন্দ্র কর্মকার প্রায় ১৮ বছর যাবৎ সংসার করছেন। চম্পা রাণীর ৩ ছেলে। বড় ছেলে পবন কর্মকার (১৬) ৯ম শ্রেণিতে, মেঝ ছেলে প্রকাশ কর্মকার (১০) ৪র্থ শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলে পার্থ কর্মকার (৭ বছর) ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। বিয়ের পূর্বে ১০ বছর বয়সে তার বাবা দূর্ঘটনায় আহত হন। বাবা কাজ করতে না পারায় সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে অনেক টাকা ঋণ নিতে হয়। ঋণের বোঝায় জর্জরিত রেখে ভাইয়েরা বাবা-মা ও তাকে ফেলে চলে যায়।
অভাবের তাড়নায় চম্পা রাণী কর্মকার জমি থেকে ধান, গম, আলু, কলই ইত্যাদি টুকিয়ে বাজারে বিক্রি করে বাবা-মাকে খাওয়াতেন। ঘরবাড়ি ভাঙা ছিল। চারিদিকে বেড়াবিহীন ঘরে বসবাস করতেন। প্রয়োজনের তাগিদে ১০ বছর বয়সে ‘জীবিকা’ নামক সংস্থায় শ্লেট, শ্লেটের ফ্রেম, খাটের পাশি বানানোর কাজে যোগ দেন। কাজ করে যা বেতন পেতেন এবং ধান, গম, আলু, কলই ইত্যাদি টুকিয়ে যে আয় হতো তা দিয়ে দু’বেলা খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে বাবা-মাকে নিয়ে বেঁচেছিলেন। পাশাপাশি তিনি বাড়িতে লেখাপড়া করতেন। কয়েকবছর পর তাঁর বাবা কিছুটা সুস্থ হয়ে সংসারের হাল ধরেন। বাবা ও মেয়ের সমন্বিত আয়ে সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে আসে।
এভাবে ৭-৮ বছরের পর ২০ বছর বযসে চম্পা রাণীর বিয়ে হয়। স্বামী পরম চন্দ্র কর্মকার স্বর্ণের কাজ করতেন। নিয়মিত কাজ না থাকায় আয় খুব কম হতো। সংসার ঠিকমতো চলতো না। বাধ্য হয়ে বিয়ের দু’মাস পর আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে হাতে সেলাইয়ের কাজে যোগ দেন চম্পা রানী। হাতের কাজ করে মাসে তিন হাজার টাকা বেতন পেতেন। পরবর্তীতে পূর্বদাশড়া নাছিরের কাছ থেকে মেশিনে সেলাইয়ের কাজ শিখেন। এরপর বারসিক আয়োজিত সেলাই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সেলাইয়ের কাজ ভালোভাবে শিখেন। কাজ শেখার পর তিনি নিজে সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতে অর্ডারের কাজ শুরু করেন। এতে তার মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় হতো। এ সামান্য আয় দিয়ে বাবা-মা, স্বামী সন্তানদের নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। এরপর তিনি অর্ডারের পাশাপাশি ব্র্যাক থেকে পাঞ্জাবী এনে সেলাই করা শুরু করেন। তিনি একবার সেম্পল দেখলে যে কোন ধরণের সেলাই কাজ করতে পারেন। তিনি ছায়া, ব্লাউজ, ম্যাক্সি, ফ্রক, কামিজ, বাচ্চাদের প্যান্ট-শার্ট ও পাঞ্জাবী কাটতে ও সেলাই করতে পারেন। বর্তমানে তিনি দর্জি দোকানের পাশাপাশি মুদি দোকান দিয়েছেন। আয় বৃদ্ধি পাবার পর তিনি একটি ছোট ঘর দিয়েছেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘বিয়ের পর আমার এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা হয়েছিল। হাতে টাকা পয়সা না থাকায় আমার স্বামী কিস্তি তুলে চিকিৎসা করিয়েছেন।’ এতকিছুর পরও তিনি ভাইদের সমস্যায় তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বড় ভাইকে ৮ হাজার টাকা দিয়ে একটি ভ্যান কিনে দিয়েছেন। অন্য ভাইদের বিপদে আপদে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
চম্পা রানী আরও বলেন, আমার কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে খুশি কর্মকার, সুমিত্রা কর্মকার ও পারভীন আক্তার তার কাছ থেকে কাজ শিখে কাজ করছেন। পরিবার ও সমাজে আমার মর্যাদা অনেক বেড়েছে। সবাই আমার কাজের প্রশংসা করে। সবাই বলে মেয়েটি অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছে। আমার যত কষ্টই হউক না কেন আমার ছেলেদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করবো। প্রয়োজনে চোখে চশমা দিয়ে কাজ করে ছেলেদের ভবিষ্যৎ করে দিয়ে যাব। ছেলেরা মানুষ হলেই আমি আমার দুঃখ কষ্ট সকল যন্ত্রণা ভুলে যাব।’
চম্পা রানীর স্বপ্ন হচ্ছে ছোট খাটো একটি সেলাই কারখানা দেয়ার যেখানে এলাকার মেয়েদের সেলাই কাজ শেখার ব্যবস্থা করা যাবে। যাতে তাঁর মতো সমস্যাগ্রস্ত নারীদের এতো কষ্ট করতে না হয়। নিজের দৃঢ় মনোবল ও কঠোর পরিশ্রম কারণেই তিনি এ সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছেন। তার এই পরিশ্রমী ও উদ্যোগী কর্মকান্ড দেখে আরো অনেকে অনুপ্রাণিত হবেন এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে কাঙ্খিত ইচ্ছা পূরণে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন এবং সমাজ পরিবার ও সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারবেন।