ঋতু রবিদাস এক আলোক দিশারী রবিদাস সম্প্রদায়ের জন্য

মানিকগঞ্জ থেকে কমল চন্দ্র দত্ত
জন্ম নয়, কর্মের মাধ্যমেই মানুষ বড় হয়। তথাপি দরিদ্র পরিবারে জন্মের পর থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়। অনেকেই এই প্রতিকূলতার বেড়াজাল ছিন্ন করে সমাজ জীবনে উচ্চাসনে আসীন হবার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে জীবন গড়ার পথে প্রয়োজন শিক্ষা। সামাজিক স্তরায়নভিত্তিক সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে তাদের পদে পদে নানারকম বাধার সন্মুখীন হতে হয়। অনেক দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ও কটুবাক্য সহ্য করে অনেকে সফলতার পথে এগিয়ে যায়। এমনই একজন আত্মপ্রত্যয়ী নারী শিক্ষার্থী ঋতু রবিদাস। উল্লেখ্য যে, তিনিই মানিকগঞ্জ রবিদাস সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জনকারী ব্যক্তি।


ঋতু রবিদাসের জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার প্রাণকেন্দ্র মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের পশ্চিম দাশড়া গ্রামের চর্মকার পট্টিতে। বিংশ শতাব্দীর আধুনিক সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনেক মানুষের নিকট এখনও তারা অস্পৃশ্য ও নিপীড়িত জাতি হিসেবে পরিচিত। ঋতু রবিদাসের জন্ম ১৯৯৪ সালে। পিতা- বিরেন ররিদাস, মাতা-উমা রবিদাস। পরিবারের সদস্য সংখ্যা আটজন। বাবা পেশায় একজন চর্মকার এবং মা গৃহিনী। বাবা জুতা সেলাইয়ের কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতো তা দিয়ে দ’ুবেলা খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে সংসার চলতো। সঙ্গত কারণেই আদর-অনাদরে, অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকে ঋতু রবিদাস।
অভাবের সংসারে বাবার কিছুটা অনিচ্ছা সত্তে¡ও মায়ের একান্ত ইচ্ছায় ৬ বছর বয়সে ঋতু রবিদাস পড়ালেখার সুযোগ পায়। বাবা-মা নিরক্ষর, কোনো সহায়ক শিক্ষক নেই। শুধুমাত্র স্কুলে শিক্ষকদের সহায়তায় পাঠ গ্রহণ করে নিজের চেষ্টায় প্রথম শ্রেণি থেকে ধাপে ধাপে সফলতার সাথে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে এবং সমাপনি পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়।


প্রথমিক স্তরের গন্ডি পেরিয়ে ২০০৪ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে তার মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। নানারকম বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বিদ্যালয়ের সেশন ফি না দিতে পারায় বিদ্যালয় থেকে নাম কেটে দেয়। বাবা টাকা-পয়সা না দিতে পারায় মেয়েকে আর পড়াবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এ কথা শোনে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণায় ঋতু রবিদাসের মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে এবং কান্নাকাটি করে। মেয়ের কান্না দেখে মায়ের মন বিগলিত হয়ে উঠে। তিনি যেকোনো উপায়ে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে স্থির করেন। অনেক কষ্টে প্রতিরেশী একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে স্কুলের শিক্ষকদের অনুরোধ করে খাতায় নাম উঠিয়ে দেন। এরপর সময়মতো বই-খাতা-কলম কিনতে ও স্কুলের বেতন না দিতে পারায় নানারকম অসুবিধায় পড়তে তাকে। সে ভাবে এভাবে চলতে পারে না। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে অনেকদূর যেতে হবে, অনেক কষ্ট করতে হবে। তাই সে লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশন করার সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের চেষ্টায় একসময় পেয়ে যায় টিউশন। চলে জীবনযুদ্ধ। কিন্তু ছোটদের টিউশন করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে বই-খাতা-কলম কেনাই অনেক সময় কষ্ট হতো। নিজের প্রাইভেট পড়ার সুযোগ কোথায়? বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সহায়ক শিক্ষক ছাড়া শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণ করে নিজ জ্ঞানে সবকিছু সমাধান করে ভালো ফলাফল করা খুব কঠিন এটা ভেবে অনেকসময় তার মন খারাপ হয়ে যেতো। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। পরিবারের পক্ষেও টাকা দেয়া সম্ভব নয়।


এ রকম পরিস্থিতিতে ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই ২০০৯ সালে বারসিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্যান্য এলাকার মতো তাদের এলাকায়ও শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রম হিসেবে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। শিশু বিকাশ কেন্দ্রে শিশুদের পাশাপাশি উপরের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গ্রæপ করে পাঠদান করা হতো। ঋতু রবিদাস সেখানে অবৈতনিকভাবে পড়ালেখার সুযোগ পায়। ঋতু রবিদাস বলেন, ‘আমি যখন হতাশায় ভুগছিলাম ঠিক তখনই আমি বারসি’কর মাধ্যমে সহায়ক শিক্ষকের পাঠ গ্রহণসহ বই-খাতা –কলম সহায়তা পেয়েছি। তা না হলে আমার পক্ষে হয়তো এস.এস.সি দেয়া সম্ভব হতো না।’


মাধ্যমিকে পড়ার সময় তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। হারিকেন বা কুপির আলোতে পড়তে হতো। পড়ার জন্য টেবিল না থাকায় বিছানায় বসে পড়ালেখা করতে হতো। এ রকম নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ঋতু রবিদাস ২০১০ সালের এস.এস.সি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে সফলতার সাথে পাশ করে এবং একই বছর মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে মানবিক শাখায এইচ.এস.সি কোর্সে ভর্তি হয়। এইচ.এস.সি পড়ার সময় বাবার আর্থিক আয় অনেক কমে যায়। পরিবারে অভাব-অনটন প্রকট আকার ধারণ করে। অনেক সময় একবেলা খেয়ে থাকতে হতো। সময়মতো কলেজের বেতন দেয়া সম্ভব হতো না। এরকম পরিস্থিতিতে তার মা মুষ্টির চাল বিক্রি করে,মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কলেজের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে মেয়ের পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে দায়। প্রাইভেট টিউটর ছাড়াই নিজের দৃঢ় মনোবল ও প্রচেষ্টায় ২০১২ সালের এইচ.এস.সি পরীক্ষায় পাশ করে।


নানারকম সংকট ও অসুবিধার মধ্যে থাকা সত্তে¡ও ঋতু রবিদাসের মনে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের আকাঙ্খা তীব্রতর হয়। সেভাবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া জীবনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে বি. এ. অনার্স (বাংলা) বিষয়ে ভর্তি হয় এবং নিজের টিউশনের টাকা দিয়ে লেখাপড়ার সমস্ত খরচ চালায়। প্রাইভেট না পড়েও নিজের চেষ্টায় ২০১৭ সালে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে অনার্স এবং ২০১৯ সালে প্রথম বিভাগ নিয়ে মাষ্টার্স পাশ করে।


তার জীবনে একটাই স্বপ্ন কর্মজীবনে প্রবেশ করে নিজেকে সামজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং সামাজিক অসচেতনতা ও শিক্ষাহীনতায় পিছিয়ে থাকা দলিত পরিবারগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি মনে করেন, একজন শিক্ষিত ব্যক্তি নিজেই নিজের পথ খোঁজে নিতে পারেন। সমাজও তাকে সম্মানের চোখে দেখেন। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বর্তমনে তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক মানিকগঞ্জে জেন্ডার প্রকল্পে কমিউনিটি ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানান, ‘আগে যারা তাকে নিচু ও অশিক্ষিত জাতি বলে অবহেলা-অবজ্ঞা করতো, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতো তারাই এখন তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখে। তিনি নিজ এলাকায় একটি দলিত শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা সহায়তা দিতে চান। যাতে রবিদাস সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের প্রতিদিনের পড়া প্রস্তুত করে যেতে পারে, কোনোরকম অসহায়ত্ব ও হতাশা বোধ না করে এবং বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের পেশার পরিবর্তনের মাধ্যমে সকল স্তরে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।


সমাজ জীবন পরিবর্তনে প্রয়োজন তীব্র ইচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্খা। ঋতু রবিদাস তার ঊজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাকে অনুসরণ করে ও অনপ্রাণিত হয়ে দলিত জনগোষ্ঠী উচ্চ শিক্ষার দিকে এগিয়ে যাবে এবং পারিবারিক ও সামাজিক বাধাগুলো দূর করে একটি সুন্দর বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে এগিয়ে যাবে।

happy wheels 2

Comments