সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতার কারণ ও নিরসনে করণীয়
সাতক্ষীরা থেকে ফাহাদ হোসেন
একটু বৃষ্টি হলেই সাতক্ষীরা শহরসহ আশপাশের অসংখ্য গ্রাম ডুবে যায়। রাস্তার উপরেই থাকে কোমর সমান পানি আর উঠানে বুক সমান। বারান্দা, ঘর, রান্নাঘরে মাছ খেলা করে। টয়লেটগুলো থাকে পানির নিচে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পানি। পশুপাখির মরা দেহ, টয়লেটের বর্জ্য ভেসে বেড়ায় এক উঠান থেকে অন্য উঠানে। এভাবে চলে বছরের ছয় মাস। ফলে, মারা যাচ্ছে এলাকার অধিকাংশ গাছপালা। মানুষজন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় বর্ষার দিনগুলোতে। আবার কেউ স্থায়ীভাবে অন্য এলাকায় ঘর তুলছে।
কয়েকবছর আগেও এই এলাকার বেশিরভাগ কৃষি জমিতে বছরে তিনটা ফসল হতো। এছাড়া পাট, সরিষা, পুঁইশাক, পালং, লালশাক, সাদাশাক, পেঁপেসহ নানান জাতের সবজি উৎপাদিত হতো এই এলাকার মাঠে। এখন বছরের অর্ধেক সময় জলাবদ্ধ থাকায় এসব ফসল করতে না পারায় মানুষজন বাধ্য হয়ে ঘেরবেড়ি করছে। ফলে, জলাবদ্ধতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। কারণ, ঘেরের জন্য বেড়ি/কিনারা অনেক উঁচু করে, যাতে বেশি পানি হলেও ঘেরের উপর দিয়ে পানি চলাচল করতে না পারে। ফলে যে পানিটা বিলে থাকতো সেটা রয়ে যায় লোকালয়ে। এদিকে, যাদের ঘের করার জমি নেই, অন্যের ক্ষেতে মজুরি দিতো, তারা হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণরূপে কর্মহীন। কারণ এক বিঘা জমিতে ধান চাষে যে পরিমান মজুর লাগে। ১০ বিঘা মৎস ঘেরে তার চেয়ে কম মজুর লাগে।
পানি প্রাকৃতিকভাবে নিষ্কাশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম নদী। কিন্তু যে খালগুলোর মাধ্যমে এলাকার পানি নদীতে পৌঁছুতো সেগুলো প্রভাবশালীদের দখলে গিয়ে এখন ঘের হিসেবে মাছ চাষ হয়। সেই খালগুলো দিয়ে পানি সরতে দেওয়া হয় না। অধিকাংশ জায়গায় খালের অস্তিত্বও নেই। খালের পাশের ঘের মালিকরা নিজের ঘেরের সাথে একত্র করে নিয়েছে খালগুলো। আবার সরকারি রাস্তার পাশ দিয়ে যে খাস জমি থাকে, যে জায়গা দিয়ে ড্রেনেজ সিস্টেম থাকতে পারতো তাও দখল করে ফেলেছে ঘের মালিকরা। তারা তাদের মৎস্য ঘেরের তিন পাশে বাধ দেয় আর একপাশের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি রাস্তা। এর ফলে, রাস্তাটাও সহজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারা যদি নিজের জমিতে আলাদা বাঁধ দেয় তাহলে রাস্তা ও সেই বাঁধের মাঝখানে অটোমেটিক একটা ড্রেনেজ তৈরি হবে। যা দিয়ে লোকালয়ের পানি নদী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে।
নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। পলি জমে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে, লোকালয়ের কিছু পানি নদীতে ভাটার সময় পার করার সুযোগ থাকলেও যেসকল স্লুইচ গেট দিয়ে লোকালয়ের পানি নদীতে দেওয়া হয় সেগুলোও পলি জমে অনেক উঁচু হয়ে থাকে। যা বর্ষার আগে অপসারণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। বর্ষার আগে এই মাটিটা ইট ভাটা বা এলাকার মানুষকে তোলার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। বর্ষায় যখন পুরো এলাকা ডুবে থাকে তখন এটা অপসারণের জন্য বাজেট এনে এলাকার প্রভাবশালীরা টাকা নয়-ছয় করার সুযোগ পায়।
এরপরও বেশিরভার পানি রয়ে যায় লোকালয়ে। বিলের পুরো পানিটা নদীতে পড়ার উপায় থাকে না। কারণ বিল নিচু, নদীর তলা উচু। আবার নদী খননে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ দেখা যায় না। পুরা নদীটা খনন করে জোয়ার ভাটা পুনরায় চালু করতে পারলে আবারো নদীটা প্রাণ ফিরে পেতো। কিন্তু কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত নদী খনন করা হয়। এবং নদী কেটে খাল বানানো হয়। নদীর মাঝে কিছুটা গর্ত করে সেই মাটি নদীর ভেতরে ও পাড়ে রাখা হয়। এবং একটু বর্ষা হলেই পাড়ে রাখা মাটি ধুয়ে আবার আগের মত ভরাট হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় নেতারা অপেক্ষা করে কখন আবারো নদী খননে বাজেট আসার। ফলশ্রুতিতে ভুগতে থাকে সেই সাধারণ জনগণ।
শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম বেতনা, মরিচ্চাপ, প্রাণ সায়ের খাল খনন করে তার সাথে সংযোগ খাল দখলমুক্ত করতে পারলে সহজে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে এলাকাবাসী। এজন্য শালিখা নদীর সাথে বেতনার সংযোগ, মরিচ্চাপের সাথে ইছামতির সংযোগ পুনঃস্থাপন, প্রাণ সায়েরের সাথে বেতনা নদীর সংযোগ তৈরী করা প্রয়োজন। প্রকল্পভুক্ত সকল নদী ও খালের সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সীমানা পিলার বসিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এবং খননকৃত নদীর সকল মাটি এই সীমানা পিলারের বাইরে ফেলতে হবে, যাতে ধুয়ে আবার নদী ভরাট না হয়। গ্রাম ও শহরের পানির ড্রেন, খাল-বিল হয়ে নদীতে পড়ার সময় যাতে ¯্রােত বাধা না পায়, কেউ দখল না করে সেটা দেখভাল করতে হবে এবং একাধিক নদীর সংযোগের ফলে পানি প্রবাহিত হয়ে নদী যাতে প্রাকৃতিকভাবে খনন হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সকল নদী-খালের ইজারা বাতিল করা জরুরি।
জলাবদ্ধতার সময় থমকে থাকে এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থা, উৎপাদন, কর্মসংস্থান। মূলত পরিকল্পনাহীনতা ও অদূরদর্শী রাজনৈতিক পদক্ষেপ, প্রভাবশালী অসচেতন মৎস্য ঘের মালিকের কারণেই সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি চায় সাতক্ষীরাবাসী। কিন্তু সেই মুক্তি দিতে ব্যর্থ সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। সরকারি দলের সদিচ্ছার ঘাটতি না থাকলে এই জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব। ২০১১ সাল থেকে অতিমাত্রায় শুরু হওয়া জলাবদ্ধতা প্রতিবছর হয়ে আসছে। আর মাত্র দেড় মাস পর বর্ষা মৌসুম শুরু হবে। পূর্ববর্তী বছরের ন্যায় এবছরেও নেওয়া হচ্ছে না আগাম কোন প্রস্তুতি।
স্থায়ীভাবে এ সমস্য নিরসনের জন্য এখনি যে প্রস্তুতি নিতে হবে
এ বছরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য প্রস্তাবনা
১. দখলকৃত খাল পানি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।
২. সরকারি রাস্তা ঘেরের বাঁধ হিসাবে ব্যবহার করতে দেওয়া বন্ধ করা হোক।
৩. পলি ভরাট হওয়া স্লুইস গেটের দুপাশের মাটি বর্ষার আগে অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হোক।
৪. বর্তমানে নদী খননের যে ধীরগতি তা রোধ করে, বর্ষার আগে নদী খনন সম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা করা হোক।
৫. পুরো নদী একবারে খনন করে জোয়ারভাটা তরান্বিত করার উদ্যোগ নেওয়া হোক।
৬. এলাকার মাঝের রাস্তাগুলো যাতে না ডোবে সেই পরিমাণ উঁচু করা হোক।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য প্রস্তাবনা
৭. বেতনা নদীর সাথে শালিখা নদীর পুনঃসংযোগ স্থাপন করা হোক।
৮. বেতনার সাথে প্রাণসায়ের এর সংযোগ স্থাপন করা হোক।
৯. মরিচ্চাপ নদীর সাথে ইছামতির সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হোক।
১০. সকল নদী খালের ইজারা বাতিল করে খাল, স্লুইচ গেট সবসময় পানি সরানোর উপযোগী করা হোক।
লেখক: সদস্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিম