শিক্ষাজীবন আনন্দময় ও সুশৃঙ্খল হোক

সিলভানুস লামিন

এক
শিক্ষাজীবন হচ্ছে সবচে’ মধুর ও আনন্দময় জীবন। কারণ এই সময় শিক্ষার্থীর মনে কোন ধরনের উদ্বিগ্নতা ও টেনশন থাকেনা। শিক্ষাজীবনটি হচ্ছে মূলত নিজেকে তৈরি করার সময়, গড়ে তোলার সময় এবং জ্ঞানে ও শিক্ষায় নিজেকে সমৃদ্ধ করার সময়। এই সময়ে ‘লেখাপড়াই’ আমাদের একমাত্র প্রধান ও প্রথম কাজ (অবশ্য অন্যান্য কাজও থাকে, সেগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ তবে লেখাপড়াই প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত)। লেখাপড়া বলতে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের পড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকা নয়; বরং সমসাময়িক অনেক বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও জ্ঞানার্জন করা বোঝায়। এ সময়ে যে নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে, ঠিকমতো ও সময়মতো লেখাপড়া করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের দেওয়া দায়িত্ব ও কর্তব্য সুচারুভাবে পালন করতে পারে ভবিষ্যতে সেই তার নিজের একটি অবস্থান তৈরি করে। শিক্ষাজীবন মানুষকে নতুন অনেককিছুর সাথে পরিচিত করে। মানুষ এ সময় নতুন ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সমাজনীতি ও রাজনীতির সাথে পরিচিত হয়। পরিবারের বাইরেও যে আরেকটি জীবন আছে, আরেকটি সম্পর্কের জাল বিদ্যমান আছে সেটা শিক্ষাজীবন থেকেই আমরা জানতে পারি। আমরা নতুন ভাষা শিখি, নতুন সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করি, নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারি, ব্যবহার করতে পারি, নতুন বন্ধু লাভ করি এবং সর্বোপরি নিজের জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর জন্য নানান রসদ লাভ করি। এই শিক্ষা জীবনকে তাই আনন্দময় করে তুলতে হবে। কোনভাবেই শিক্ষালাভের এই প্রক্রিয়াকে অবহেলা করা যাবে না; একে বিরক্তিকর বলে মনে করা ঠিক হবে না। বরং নানান সমস্যা থাকলেও এই শিক্ষাজীবনকে উপভোগ করার কৌশল আয়ত্ব করতে হবে। শিক্ষার এই জীবনকে উপভোগ করতে পারলে কোন বাঁধাই আমাদেরকে আটকে রাখতে পারবে না।

দুই
শিক্ষা শব্দটি ‘শাস’ ধাতু থেকে এসেছে যার অর্থ হলো স্বাধীন। আমরা কিন্তু স্বাধীন হতে পছন্দ করি। কারও অধীনে থাকতে চাই না। মানুষের সহজাত স্বভাবই হচ্ছে সে স্বাধীনচেতা। তাই নিজের জীবনকে স্বাধীনভাবে পরিচালনার জন্য আমাদের পড়তে হবে, জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং নানান বিদ্যা ও তথ্যে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। এই শিক্ষাজীবনে চারটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়গুলো হলো: ধৈর্য্য (Patience), জেদ (Persistence), অধ্যবসায় (Perseverance) এবং আবেগ (Passion) বা ৪টি P। কোনকিছু একবার বুঝতে না পারলে ‘ধৈর্য্য’ ধরে বারবার পড়তে হবে, অকৃতকার্য হলে ভেতরে ‘জেদ’ ধরতে হবে যে, অন্যরা পারলে আমি কেন পারবো না? আমি অবশ্যই পারবো। অন্যদিকে শিক্ষার্জনের সবচে’ বড় কৌশল হচ্ছে ‘অধ্যবসায়’। পৃথিবীতে যারা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে সমাজ ও বিশে^র দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছেন তারা সবাই অধ্যবসায়ী ছিলেন। এছাড়া শিক্ষার প্রতি আমাদের ‘আবেগ’ও থাকতে হবে। এই আবেগই আমাদেরকে আরও বেশি জ্ঞানার্জন করার দিকে ধাবিত করবে। কোন বিষয়ের প্রতি আবেগ থাকলে সেই বিষয়টিকে আকড়ে ধরার চেষ্টা করি আমরা। শিক্ষাজীবনে তাই ‘শিক্ষাই’ আমাদের আবেগ বা প্যাশন হওয়া উচিত। শিক্ষা যেহেতু মানুষকে স্বাধীন করে তোলে তাই শিক্ষিত হলে আমরা নিজেরাই নিজের কাজ করতে পারি, কারও উপর নির্ভরশীল হবো না। শিক্ষিত হলে আমরা পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝা না হয়ে সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবো। পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নে আমরা ভালো ভূমিকা রাখতে পারবো। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে মানবসম্পদে পরিণত করে। তাই আমাদের পড়তে হবে, জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং নিজেকে ‘সম্পদ’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার কোন সীমা ও শেষ নেই! শিক্ষা একটি চলমান ও প্রবহমান প্রক্রিয়া। স্কুলজীবন এই সীমাহীন শিক্ষালাভ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। এ ধাপে আমরা যদি সফল হই তাহলে পরের ধাপগুলোর জন্য এই সফলতা শক্ত ‘ভিত্তি’ হিসেবে কাজ করবে।

তিন
শিক্ষাজীবন শুধুমাত্র আমাদেরকে জ্ঞান ও তথ্য দেয় না; বরং আমাদেরকে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের কৌশল শিখে দেয়। একজন শিশু যখন স্কুলে যায় তাকে স্কুলের সব ধরনের নিয়মকানুন মানতে হয়; বড়দের শ্রদ্ধা করতে হয়, সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে শেখানো হয়। এভাবে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও তাকে শিখতে হয় আদব-কায়দা, নিয়ম শৃঙ্খলা, আচার-আচরণ ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে, মানুষ চারবার জন্মগ্রহণ করে। এক: কোনও নারীর গর্ভে ভ্রƒণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ হওয়ার পর প্রথম জন্ম। দুই: শারীরিকভাবে ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর দ্বিতীয় জন্ম। তিন: সামাজিক জন্ম এবং চার: মনস্ততাত্তিক জন্ম। একটি শিশু জন্ম নেওয়ার পর বাবা-মা, পারিবারিক পরিবেশের সাথে পরিচিত লাভ করে। এর মাধ্যমে শিশু সমাজের কাছ থেকে অনেক কিছু (সামাজিক নানান নিয়ম কানুন, আদব কায়দা, শৃঙ্খলা) শেখে। একে সামাজিক জন্ম বলে। সাধারণত তিন থেকে চার বছরের মধ্যে শিশুর সামাজিক জন্ম হয়। তবে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর বয়স ৫ বছর হওয়ার পর এ পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত হয়। অন্যদিকে একটি শিশুর মন-মানসিকতা আস্তে আস্তে পরিপক্কতা লাভ করে। তার নিজস্ব একটি চিন্তা, দর্শন এবং চেতনা গড়ে উঠে। এভাবে একটি শিশু মনস্তাত্তিকভাবে জন্ম লাভ করে। সাধারণত আমাদের দেশে একটি শিশুর বয়স ১০/১২ বছর বয়সে মনস্তাত্তিকভাবে জন্ম লাভ করে। দেখা যায়, সামাজিক বা মনস্তাত্তিকভাবে জন্মলাভের জন্য একজন মানুষকে পরিবার ও সমাজ (স্কুল ও পারিপাশির্^কতা) থেকে অনেককিছু শিখতে হয়। এ জন্য বলা হয় মানুষ ‘মানুষ’ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না; ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য তাকে সাধনা করতে হয়। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানুষকে নানান মানবিক গুণাবলী শেখায়, শৃঙ্খলাবোধ শেখায় এবং পরিপূর্ণ একজন হওয়ার জন্য নানান নিয়নকানুন, জ্ঞান দিয়ে তাকে সজ্জিত করে। এভাবে শিক্ষালাভের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন মানুষ সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে জন্মলাভ করে, তার ভেতরে নিজস্ব একটি দর্শন ও চেতনা গড়ে উঠে এবং শিক্ষালাভের মাধ্যমে এ দর্শন ও চেতনা তৈরি হওয়ায় তার জীবনটা হয় সুশৃঙ্খল।

happy wheels 2

Comments