কৃষাণ-কৃষাণীদের অল্পনা রানীর কৃষিবাড়ি পরিদর্শন
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে এদেশের গ্রামীণ জীবনযাত্রা কোন ভূমিকা না রাখলেও এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে গ্রামীণ জনপদই। বলা হয়, ধনী দেশের মানুষের ভোগ বিলাসিতার কারণে জলবায়ু অতিদ্রুত গতিতে পরিবর্তন হচ্ছে। তারপরও স্থানীয় পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলার গ্রামীণ জনগণ অবিরাম এই পরিবর্তন প্রশমন এবং কখনও অভিযোজন করেছেন।
বাংলাদেশের গাঙ্গীয় প্লাবণ সমভূমি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের গ্রামীণ জনগণও সেদিক থেকে পিছিয়ে নেই। ওই এলাকার মানুষেরা পারস্পরিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমেই অবিরামভাবে এই পরিবর্তন প্রশমন ও অভিযোজন করেছেন। পাশাপাশি প্রাণবৈচিত্র্যের বিভিন্ন ধরন ও তার সাথে যে সম্পর্ক এবং পারস্পারিক আন্তঃনির্ভরশীলতার প্রক্রিয়াকে গতিশীলতায় ভূমিকা রেখে চলেছেন।
নিজেদের মধ্যে পারস্পারিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা এবং সম্পদ বিনিময়ের ধারবাহিকতায় আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি বারসিক শ্যামনগর রিসোর্স সেন্টারের উদ্যোগে কৃষক-কৃষক অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের অংশ হিসেবে উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা, গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা, কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগর ও কাঠালবাড়ি, মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কালিনগর ও হরিনগর, ইশ্বরীপুর ইউনিয়নের কেওড়াতলী, কৈখালী ইউনিয়নের মধ্য কৈখালী, রমজাননগর ইউনিয়নের মানিকখালী, শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের বেতাঙ্গী গ্রামের ৩৫ জন অভিজ্ঞ কৃষক-কৃষাণী ইশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধমুঘাট গ্রামের কৃষাণী অল্পনা রানী মিস্ত্রীর প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ আমাদের কৃষি বাড়ি পরিদর্শনে আসেন।
পরিদর্শনের পরিদর্শন দল পর্যায়ক্রমে অল্পনা রানীর স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থাপনা, জৈব পদ্ধতিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদ, বীজ সংরক্ষণ, বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গাছের বনায়ন, প্রাণীসম্পদ (গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, কবুতর, জৈব ও ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন, অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্লট, পুকুরে স্থানীয় মাছ চাষ, মুরগির ডিম ফোটানো প্রাকৃতিক পাত্র হাজল ও জ্বালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব বন্ধু চুলাসহ নানা ধরনের শুটকি খাদ্য তার বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা স্মারক পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শন শেষে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্টিত হয়। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা অল্পনা রানী তার এ বাড়ি এতো প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ কিভাবে করেছেন, কতবছর যাবত এ কাজ করছেন, কাদের পরামর্শে এ কাজ করছেন, কিভাবে ফসল পরিচর্যা করেন, কিভাবে বীজ সংরক্ষণ রাখেন এ বীজ কি করেন, কিভাবে সংগঠন তৈরি করেন, সংগঠনের সদস্য সংখ্যা কতো, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু পুরুস্কার অর্জনে অনুভূতি কি ছিল, পরিবেশবান্ধব যে চুলা ব্যবহার করেন তার গুরুত্ব কি এসব বিষয়ে জানতে চান এবং একে একে অল্পনা রানী তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন। এরপর পরিদশর্নে অংশগ্রহনকারীরা তাদের শিক্ষনীয় এবং অনুভূতির কথা তুলে ধরেন।
কৃষাণী রাবেয়া, রেহানা, বকুল, রত্না, অর্চনা ও আফরোজা বেগমরা জানান, তাঁরা আজকে বিভিন্ন কৃষক-কৃষাণীরা অল্পনা রানী মিস্ত্রীর যে কৃষিকাজ ও জীবনযাত্রা পরিদর্শন করেছেন এর মাধ্যমে তারা পরস্পর কৃষিভিত্তিক জ্ঞান-দক্ষতা বিনিময় করেছেন। এভাবে প্রতিটি মৌসুমে তারা সবাই উদ্যোগ নিয়ে সফর করলে সব গ্রামের কৃষক-কৃষাণীই লাভবান হবে। পাশাপাশি নারীরা একত্রিত হতে পারবেন এবং সংগঠিত হতে সহায়তা করবে বলে তারা মনে করেন। কৃষক মো. সিদ্দিকুর রহমান ও আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের এ অঞ্চলের কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও চাষাবাদের জন্য কৃষকদের প্রতিটি ফসল মৌসুমে পারস্পরিক জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। তাদেরকে চিংড়ি চাষের পরিবর্তে কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রার জন্য পরামর্শ দিতে হবে। কৃষক-কৃষক এবং কৃষক সংগঠনগুলোর পারস্পরিক ঐক্য সৃষ্টি করে সরকারি, বেকরকারি সুযোগ-সুবিধা আদায়ে তাদেরকে সংগঠিত করতে হবে।”