সাম্প্রতিক পোস্ট

‘কাঁশ’: দুর্যোগকালীন গো খাদ্য

গাইবান্ধা থেকে অমৃত সরকার::

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার আয়তনের বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে চর। ফুলছড়ি উপজেলায় ছোট-বড় চর মিলিয়ে মোট ৫৭টি চর আছে। এলাকার কৃষাণ-কৃষাণী গবাদিপশু পালন করে চরগুলোকে চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া পশুর চারণভূমিগুলো দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। চারণভূমির অভাব এবং বন্যার কারণে কৃষাণ-কৃষাণীরা তাদের পশুর জন্য খাদ্য যোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমতাবস্থায় ‘কাঁশিয়া’ (কাঁশ) বিকল্প গো খাদ্য হিসেবে তারা ব্যবহার করছেন দীর্ঘদিন থেকে। যদিও সংরক্ষণসহ অন্যান্য কারণে প্রাকৃতিক এই গো খাদ্যের অস্তিত্ব আজ অনেকটা বিপন্ন।

বর্ষায় চরগুলোতে প্রচুর কাঁশিয়া (কাঁশ) জন্মো। কাঁশিয়া একটি উংকৃষ্ট মানের গো-খাদ্য, বিশেষ করে এর কচি পাতাগুলো। বর্ষায় যখন চারণভূমিগুলো পানিতে প্লাবিত হয় ঠিক তখনই প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কাঁশিয়া কৃষাণ-কৃষাণীদের গো খাদ্যের সঙ্কট নিরসনে সহায়তা করে। বর্ষায় সাধারণত গবাদিপশুগুলো ধানের খড় খাওয়ানো হয়। কিন্তু সবার বাড়িতে পর্যাপ্ত পরিমাণ খড় থাকে না। তাই খড়ের প্রাপ্যতা কম হলে কৃষকেরা তাদের গবাদিপশু বিশেষ করে গরু কাঁশিয়া খাওয়ান। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কাঁশিয়ার প্রাপ্যতা বেশি হলে এটি সংগ্রহে কৃষককে প্রচুর শ্রম দিতে হয়। কাঁশিয়ার পাতাগুলো ধাঁরালো হওয়ায় সংগ্রহের   ক্ষেত্রে প্রচুর শ্রম ও বেশি সময় লাগে। তুলনামূলকভাবে কচি নরম কাঁশিয়া গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে সংগ্রহ করেন কৃষকেরা। একজন কৃষক তার নৌকা নিয়ে সারাদিন কাঁশিয়া সংগ্রহ করে থাকে। এমনকি অনেকসময় তাকে খাবার দাবারও সেই নৌকার উপরই সেরে নিতে হয়।  সাধারণত একদিন কাঁশিয়া সংগ্রহ করলে সংগৃহীত এই পাতা দিয়ে কৃষক ১০ থেকে ১৫ দিন তার গবাদিপশুকে খাওয়াতে পারেন। কৃষক মো. দুলু মিয়া এবং মো. দুলা মিয়া বলেন ‘আমাদের এখানে সাধারণত আষাঢ় মাসে পানি আসে তখন আমরা আমাদের গরুগুলোকে মাঠে নিয়ে যেতে পারি না। এরপর থেকে যতদিন পানি থাকে আমরা ঠিক ততদিন গরুকে কাঁশিয়া কেটে খাওয়াই”। এলাকার বিভিন্ন কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা কাঁশিয়া সংগ্রহ করে সেগুলো সংরক্ষণ করেন যাতে করে আষাঢ় মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত তাদের গরুকে খাওয়াতে পারেন।

কৃষকেরা জানান কাঁশিয়া কাঁচা অবস্থায় গরুকে খাওয়ানো হলে বেশি উপকার পাওয়া যায়। এতে গরুর দুধও বৃদ্ধি পায়। তবে কাঁশিয়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষককে একদিনের শ্রমঘণ্টা ব্যয় হয় এবং অনেক কষ্ট করতে হয়। তাই তারা একদিন কাঁশিয়া সংগ্রহ করে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত এটি সংরক্ষণ করে খাওয়ায়। সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষকেরা প্রথমে তুলনামূলক নরম ও কচি কাঁশিয়া কেটে ছোট ছোট করে আঁটি বাঁধেন। তারপর আঁটিগুলো পানিতে ভালো করে ধুয়ে নেন। যাতে কাঁশিয়ার সাথে কোন প্রকার বালি না থাকে। এরপর যে জায়গায় কোমর পরিমাণ পানি জমে থাকে সে জায়গায় একটি  বাঁশ পুঁতে নেন।  বাঁশের মধ্য একটি করে কাঁশিয়ার আঁটি দিয়ে পানির উপর ভাসমান অবস্তায় রাখেন। বাঁশকে মাঝে রেখে কাঁশিয়ার আঁটিগুলোকে এমনভাবে রাখেন যাতে প্রতিটি কাঁশিয়ার আঁটিগুলোই পর্যাপ্তভাবে পানির সংস্পর্শে থাকে। বাঁশের সাথে বেঁধে রাখার মূল কারণ হচ্ছে কাঁশিয়াগুলো যাতে পানিতে ভেসে না যায়। কৃষকেরা এইভাবে সংরক্ষণ করেন। সাধারণত একজন কৃষক তার গরুকে সারাদিন খাওয়ানোর পরিমাণের কাঁশিয়া সংরক্ষিত জায়গা থেকে তুলে নিয়ে আসেন। এই প্রসঙ্গে কৃষক মো. হাসেম আরির বলেন, “আমার গরুগুলোর জন্য দিনে ১০-১২ আঁটি কাঁশিয়ার প্রয়োজন হয়। আমি সংরক্ষিত কাঁশিয়া থেকে ১০-১২ আটি কাঁশিয়া তুলে এনে পানি ঝড়িয়ে নিয়ে কেটে গরুকে খাবার হিসেবে দিই। অবশ্য কেউ কেউ সংরক্ষিত কাঁশিয়া না কেটেও গরুকে খাবার হিসেবে দিয়ে থাকে। তবে কেটে গরুকে খাওয়ানোই উত্তম। কারণ গোটা দিলে গরুর খেতে অসুবিধা হয় এবং কাঁশিয়া নষ্ট করে। তবে যে কাঁশিয়া গরু নষ্ট করে তা আবার জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়”। কাঁশিয়া খাওয়ালে গরুর দুধ উংপাদন বৃদ্ধি পায়। দূর্যোগের সময় কাঁশিয়া খাওয়ানো হয় বলে খড়ের উপর চাপ কমে। কাঁশিয়া যখন গবাদি পশুকে খাওয়ানো হয় সে সময় গরুকে কোনরূপ খড় না খাওয়ালেও চলে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত খড় খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় না বলে এই তিন মাসের খড় বছরের অন্য সময়ে ব্যবহার করা যায়। কাঁশিয়ার ডাটাগুলো মিষ্টি হওয়ার কারণে গরু এটাকে পছন্দ করে। এছাড়া কাঁশিয়া জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

যুগ যুগ ধরে কৃষকেরা তাদের নিজের প্রয়োজনে, প্রকৃতির সাথে অভিযোজন করার জন্য তাদের মেধা ও শ্রম ব্যবহার করে উদ্ভাবন করেন নানান অভিযোনিক কৌশল। আর এই কৌশলের গুণেই নানান সঙ্কটের মাঝেও তারা বেঁচে আছেন, জীবন-জীবিকাকে সচল করার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন করার জন্য গ্রামবাংলার কৃষকদের এই লোকায়ত অভিযোজনিক কৌশলকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

happy wheels 2

Comments