পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেন গ্রামীণ নারীরাই
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী ও খাদিজা আক্তার লিটা
নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের অরঙ্গবাদ গ্রামে গতকাল কিশোরী-কিশোরী, কৃষাণী ও যুব সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামীণ নারী দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে গ্রামের জনগোষ্ঠীর অঙশগ্রহণে এক আলোচনা সভা, কৃষাণীদের জন্য অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদের রান্না প্রতিযোগিতা, কিশোর-কিশোরীদের জন্য কুইজ-কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
সকাল ১০টায় তিনটি জনসংগঠনের সদস্য ও গ্রামের প্রায় ৬৫ জন নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে দিবসের কার্যক্রম আরম্ভ হয়। শুরুতে অংশগ্রহণকারী নারী ও কিশোরীরা রান্না প্রতিযোগিতার জন্য তাদের বসতভিটা ও কৃষি ক্ষেত থেকে অচাষকৃত ১০ জাতের সবজি সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে ১০ জন নারী তাদের সংগৃহীত অচাষকৃত দশ জাতের খাদ্য উদ্ভিদগুলো নিজস্ব রেসিপিতে রান্না করেন। কিশোরী ও যুব সংগঠনের ২০ জন সদস্য কুইজ-কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতার শেষে দিবসটি উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় তিনটি সংগঠনের সদস্যসহ গ্রামের বিভিন্ন বয়সের (প্রবীণ, প্রতিবন্ধি, নারী, কিশোর-কিশোরী, যুব ও শিশু) ৬৫ জন লোক অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনার শুরুতে বারসিক’র কর্মী রুখসানা রুমী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টি সকলের নিকট তুলে ধরেন। গ্রামীণ নারীরা শহরের নারীদের চেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। গ্রামীণ নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও তাদের অবদানের স্বীকৃতির জন্য এই দিনটি প্রতি বছর পালিত হয়।’
বারসিক’র কর্মী শংকর ম্রং আলোচনায় বলেন, ‘দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে শুনলেই দিবসটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেকটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। গ্রামীণ নারীরা তাাদের পরিববার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সন্তান লালন-পালন, সন্তানদের স্কুলে পাঠানো, গবাদিপশু-পাখি পালন, রান্না-বান্না, বসতভিটায় সবজি চাষ, বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ থেকে শুরু করে স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুরীর সেবাসহ সকল কাজ নারীরাই করে থাকেন। এক কথায় পরিবারের সার্বিক উন্নয়নের অনেকটা ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্য সেবা নারীরাই নিশ্চিত করে থাকে। কিন্তু পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নারীদের এসব অবদানের স্বীকৃতি তো নেইই, বরং পুরুষ শাসিত পরিবার ও সমাজে নারীরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার। গ্রামীণ পরিবারে ও সমাজে নারী ও শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। পরিবারের পুরুষ শিশুদের চাহিদা, ইচ্ছা ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও কন্যা শিশুদের ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়না। অবহেলা ও সহযোগিতার অভাবে গ্রামের নারী ও কন্যা শিশুরা তাদের মেধা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছেনা। তাই এখন যারা কিশোর ও যুবক তাদেরকে নিজ নিজ পরিবার, পাড়া, গ্রাম ও সমাজের প্রত্যেক নারীদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করতে হবে।’
যুব প্রতিনিধি আব্দুল আলীম বলেন, ‘দিবসটি উদ্যাপন করে আমরা দিবসটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেমন জানতে পেরেছি, তেমনি অনেক জাতের অচাষকৃত খাদ্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি, যেগুলো আমরা কখনো খাইনি এবং এগুলো যে উত্তম খাদ্য সে সম্পর্কেও আমরা জানতাম না।’
কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী কিশোরী বৃষ্টি আক্তার তার অনুভূতি জানায় এভাবে, ‘আমাদের চারপাশে অনেক অজানা-অচেনা উদ্ভিদ প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। আমরা সেসব উদ্ভিদের কিছু খাদ্য হিসেবে খাই, কিন্তু বেশিরভাগ উদ্ভিদ আগাছা মনে করে কেটে ফেলি। অথচ সেগুলোর অকেটাই খাওয়া যায়। আজ কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদের রান্না থেকে প্রাকৃতিকভাবে জম্মানো এসব অজানা খাদ্য উদ্ভিদগুলো সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি।’
আলোচনা শেষে অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদের রান্না প্রতিযোগিতায় বিজয়ী নারী এবং কুইজ-কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী কিশোর-কিশোরীদের পুরস্কৃত করা হয়। বিজয়ীদের ছাড়াও রান্না প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক নারীকে উৎসাহ প্রদানে সান্তনা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
অন্যদিকে একই সময়ে নেত্রকোনা জেলার আমতলা ইউনিয়নের আমতলা ও শাপমারা গ্রামের কৃষাণীদের উদ্যোগে পালিত হয়েছে গ্রামীণ নারী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বেসরকারী সংস্থা বারসিক ও গ্রামের কৃষাণীদের উদ্যোগে আলোচনা সভা, র্যালি, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিবসটি তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন বারসিক কর্মকর্তা খাদিজা আক্তার লিটা।
নারী ও কন্যা শিশুর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে আমতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক নুরুল আমীন বলেন, ‘আমাদের গ্রামের নারীদের পাশাপাশি উপস্থিত পুরুষরাও পরিবারে নারী ও কন্যা শিশুদের পুরুষ ও ছেলে সন্তানে সমান মর্যাদা দিতে হবে। শহরের তুলনায় গ্রামের নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছে, কারণ অধিকাংশ পরিবারের নারী সদস্যরা কোন ধরনে আর্থিক কাজের সাথে জড়িত নয়, অথচ গ্রামের নারীরাই আমাদের জীবনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নিরাপদ খাদ্যের যোগান দেয়। সরকারিভাবে গ্রামীণ নারীদের এ কাজে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, তাদের কাজে স্বীকৃতি তাদের ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখবে।’
ইউপি সদস্য আনোয়ার বলেন, ‘সময়ের সাথে সাথে সমাজ ব্যবস্থা বদলাচ্ছে আগের তুলানায় নারীদের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ক্ষমতায়নে নারী বা পরিবারে কন্যা শিশুর কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা আজ বিবেচনার বিষয়, এখনও আমাদের অধিকাংশ পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুরুষরাই মূল ভূমিকা রাখেন। সরকার শিক্ষা, কর্ম ক্ষেত্রে সকল কাজে নারীদের সমান সুযোগ দিলেও সিদ্ধান্ত বা ক্ষমতায়নে এখনও আমাদের নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে।”
অনুষ্ঠানে শেষে অংশগ্রহণকারীরা পরিবারের নারী ও পুরুষ ভেদাভেদ ভূলে সব নারী ও কন্যা শিশুদের অধিকার আদায়ে কাজ করার জন্য শপথ গ্রহণ করেন।