জাল জলে জীবন চলে

সাতক্ষীরা থেকে মহিরঞ্জন মন্ডল

শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের উত্তর পাখিমারা গ্রামের একটি অসহায় ও হতদরিদ্র পরিবার আনোয়ারা বেগমের । আনোয়ারা বেগমের বয়স ৬০ বছর। স্বামী মারা গেছেন ১৫ বছর পূর্বে। তিন ছেলে নিয়ে অনেক কষ্টে আনোয়ারা বেগম তার সংসার চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু নিয়তি বড়ই কঠিন! একজন মা তার তিন ছেলেকে ভরণপোষণ দিয়ে মানুষ করতে পারে কিন্তু  তিন ছেলে মিলে একজন মাকে ভরণপোষণ দিতে পারেন না। আনোয়ারা বেগমের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।

বর্তমানে তিন ছেলে বিয়ে করে সবাই পৃথক হয়ে সংসার করছেন। আনোয়ারা বেগমকে খেতে দেওয়ার মত কোনো ছেলেরই তেমন ইচ্ছে নেই। ফলে আনোয়ারা বেগম এই বয়সে দিন মজুরি করতন আর ছোট ছেলে আছাদুল ইসলামের সংসারে কোনোরকমে থাকেন। ছোট ছেলে আছাদুলেরও অভাবের সংসার। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসারে দিন কাটে আনোয়ারা বেগমের ছেলে আছাদুল  ও পুত্র বধু শারমিনের ৷  আছাদুল  দিনমুজুরের কাজ করেন৷ বছরের সব সময় কাজ হয় না৷ অন্যের মাছের ঘেরে কৃষি দিনমজুর হিসাবে বছরে দুই থেকে তিন মাস কাজ করতে পারেন আছাদুল ৷ তাঁর  দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে পড়ে ৪র্থ  শ্রেণীতে এবং ছেলে প্রথম শ্রেণীতে৷ ফলে এমনিতেই অভাবের সংসার তার উপর দুই ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় আছাদুল এবং শারমিনকে৷

বসত ভিটায় জায়গার পরিমাণ কম থাকায় এবং সামর্থ্য না থাকায় নিজেদের বসবাস করার ঘরটাও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কয়েকবার ভেঙে গেছে আছাদুলের৷ ঘরের চালের টিন উড়ে চলে গেছে৷ দুর্যোগ কেটে গেলে আবার কোন রকমে ঘরটা মেরামত করে নতুন করে আশার স্বপ্ন বুনে। এরকম পরিস্থিতিতে আনোয়ারা বেগম ও তার পরিবার যখন পুরোপুরি দিশেহারা ঠিক তখনই  পি, আর, এ এর মাধ্যমে বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের কৃষ্ণচূড়া  দলের সদস্য হিসাবে যুক্ত হন আনোয়ারা বেগম৷

একদিন বারসিক অফিস থেকে ফোন পান আনোয়ারা বেগম ৷ তিনি জানতে পারেন যে, আগামী মঙ্গলবার মিটিং হবে তাকে যেতে হবে৷ এরপর থেকে তিনি প্রতি সপ্তাহে গ্রুপ মিটিং এ হাজির হতে থাকেন এবং একটা পর্যায়ে জলবায়ু সহনশীল কৃষি চর্চা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রাণী সম্পাদের লালন পালন, পরিচর্যা ও বসতভিটায় যে সামন্য জায়গা রয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে সবজি চাষ করতে হয় সে বিষয়ে জানতে পারেন৷ আনোয়ারা বেগম অনেক ভেবে চিন্তে দেখলেন যে, এই বয়সে তিনি তেমন কিছু করতে পারবেন না। তবে তিনি যে ছেলের সংসারে থাকেন তাকে যদি কোনোভাবে সংসার চালানোর কাজে সহযোগিতা করতে পারেন তাহলে তিনি হয়তো দুই বেলা দুমোঠো ভাত খেতে পারবেন। ফলে তিনি তার ছোট ছেলের সাথে পরামর্শ করে  আইজিএ (আয়বর্ধনমূলক কাজ) হিসাবে নদীতে মাছ ধরার নৌকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং নেটজ্ বাংলাদেশের সহায়তায় বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের মাধ্যমে ১২৫০০ টাকা মূল্যের একটি নৌকা  নেন। বাকি টাকা আইজিএ হিসাবে হাঁস মুরগি নেন৷

নদীর চরে বড়ি হওয়ায় ছোট ছেলে আছাদুল দিন রাত পরিশ্রম করে নৌকায় জাল ধরে ২০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন তা দিয়ে তিনি ওিই নৌকায় একটা মেশিন সেট করে নেন। আগে যেহেতু নৌকায় মেশিন ছিল না তাই তিনি মাছ ধরতো নদীর কুল দিয়ে। এখন তিনি মেশিন বসিয়ে নিয়েছেন নৌকায়। তাই তিনি বেশি মাছ ধরার জন্য মাঝ নদীতে যান এবং মাছও ভালো পান।

তাদের পরিবার এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো চলে। যেহেতু আনোয়ারা বেগম সদস্য এবং তার মাধ্যমে আছাদুল নৌকা পেয়েছে এবং সংসারে উন্নতি করছেন। আনোয়ারা বেগম বলেন, “আগে তিন বেলা খেতে পেতাম না, বারসিক লৌকাডা দেওয়ায় এখন তিন বেলা নুন দে খাতি পারি।” আনোয়ারা বেগম  স্বপ্ন বুনছেন তার ছেলেকে বলে তার বসবাসের ঘরটি নতুন করে মেরামত করিয়ে নেবেন এবং তার নাতি ও পুতনীকে নতুন করে ভালো শিক্ষকের নিকট প্রাইভেটে দেবেন। বারসিক থেকে নৌকা পেয়ে আনোয়ারা বেগম এখন অনেক খুশি এবং তিনি নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

happy wheels 2

Comments