যুবক লিটন চন্দ্র দাস নেত্রকোনার গর্ব
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং ও আব্দুর রব
‘একনিষ্ঠ অধ্যবসায়, চেষ্টা, পরিশ্রম, সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা একজন মানুষকে সাফল্যের শিখরে পৌছে দেয়’ কথাটি আবার প্রমাণ করল বাংলাদেশের বেশ ক’জন সফল যুব উদ্যোক্তা। তাদের একনিষ্ঠ চেষ্টা, পরিশ্রম সফল যুব আত্মকর্মী হিসেবে এনে দিয়েছে জাতীয় যুব সম্মাননার মত দূর্লভ সম্মান। নেত্রকোনা জেলার সফল আত্মকর্মী লিটন চন্দ্র দাসের কথা বলছি, যিনি এবারে এ সন্মানে ভূষিত হয়েছেন। এর পূর্বে নেত্রকোনা জেলার কোন যুবক এসম্মানে ভূষিত হয়নি। আত্মকর্ম সংস্থানের মাধ্যমে যুব কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য জাতীয় পর্যায়ে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। নেত্রকোনা জেলায় এযাবৎকাল পর্যন্ত লিটন চন্দ্র দাসই প্রথম এই সম্মাননাটি বয়ে নিয়ে আসেন নেত্রকোনার জন্য। পহেলা নভেম্বর ২০১৭ ঢাকায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির হাত থেকে লিটন চন্দ্র দাস সম্মাননাটি গ্রহণ করেন।
নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের রামেশ্বরপুর গ্রামের কৃষক অসিত চন্দ্র দাস (৫৩) ও মা লক্ষ্মী রানী দাস (৪৬) এর দুই ছেলের মধ্যে মেজো লিটন চন্দ্র দাস। বড় ভাই রিপন কুমার দাস সিঙ্গাপুর প্রবাসী। ২০০৪ সালে স্নাতক (বিএ) পাশ করার পর চাকরির চেষ্টা না করে কৃষি কাজে বাবাকে সাহায্য করার পাশাপাশি উপজেলা ও জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে দক্ষতামূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য যোগাযোগ করেন। আটপাড়া উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় লিটন চন্দ্র দাস নেত্রকোনা জেলা যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে এক মাস মেয়াদী ‘মৎস্য চাষ ও ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়াও তিনি একই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে তিনমাস মেয়াদী ‘গবাদী পশু-পাখির প্রাথমিক চিকিৎসা’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ, ৬ মাস মেয়াদী ‘বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ’, ‘ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি মেরামত প্রশিক্ষণ’, সাত দিন মেয়াদী ‘পল্ট্রী খাদ্য তৈরি’ প্রশিক্ষণ এবং বিসিক থেকে ১৫ দিন মেয়াদী ‘কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ’ এর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণগুলোর পর লিটন দাস মাছ চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উৎসাহে যুব উন্নয়ন ঋণ নিয়ে এবং পিতার কাছ থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে তিনি পৈত্রিক একটি পুকুরে প্রথমে মাছ চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরেই মাছের খামার থেকে লাভের মূখ দেখতে পেয়ে তার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। লাভের টাকায় তিনি পৈত্রিক জমিতে আরও ৫টি পুকুর খনন করেন। বর্তমানে তিনি নিজস্ব ৬টি পুকুর এবং লিজ নেয়া পুকুর ৪টিসহ মোট ১০টি পুকুরের ৬.৫ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে মাছের চাষ করছেন। পুকুরে তিনি শুধু মাছই চাষ করেন না, মাছের পোনাও উৎপাদন করেন।
মাছ চাষ করেই খান্ত হয়নি প্রাণচঞ্চল, উদ্যমী ও পরিশ্রমী সফল এই যুব উদ্যোক্তা। অন্যান্য মাছ চাষিদের পুকুরের মাছের বিভিন্ন রোগ-বালাই ও গবাদী পশু-পাখির বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মোবাইল ফোনে কোন কৃষক মাছ ও গবাদী পশু-পাখির সমস্যায় তাকে ডাকলে তিনি সেখানে ছুটে যান এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেন। আবার অনেকে লিটন দাসের বাড়িতে তাদের গবাদী পশু-পাখি নিয়ে আসেন এবং তিনি অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে গবাদী পশু-পাখির চিকিৎসা প্রদান করেন।
এছাড়াও লিটন চন্দ্র দাস তার দুই কাঠা (২০ শতাংশ) জমিতে পানের চাষ করেছেন, এক কাঠা জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজির চাষ করেছেন, পুকরের পারে মাসকলাই, পেঁপে ও সীম চাষ করেছেন। এসব সবজি নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সবজি বাজারে বিক্রি করেও বেশ ভাল অংকের টাকা আয় করে থাকেন। এছাড়া তিনি গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প পরিচালনা করে ভালোই লাভবান হন।
২০১৬ ও ২০১৭ দুই বছরে লিটন চন্দ্র দাস তার ১০টি পুকুর থেকে এক কোটি নয় লাখ টাকা আয় করেছেন বলে জানান। লাভের টাকা থেকে তিনি চার লাখ টাকায় মাছ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোব এগ্রোভেট লিঃ’ এর ডিলারশিপ নেন। বর্তমানে মাছের খাদ্য বাজারজাতকরণ ব্যবসায় এ নাগাদ পর্যন্ত সতের লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
লিটন চন্দ্র দাসের উল্লেখযোগ্য অর্জন
২০১০ সাল থেকে মাছ চাষ করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লিটন চন্দ্র দাস উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায় থেকে তার কাজের বেশকিছু স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার প্রাপ্ত স্বীকৃতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ঃ
১. ২০১৫ সালে আটপাড়া উপজেলার শ্রেষ্ঠ সফল আত্মকমীর সম্মাননা।
২. ২০১৬ সালে আটপাড়া উপজেলার শ্রেষ্ঠ সফল আত্মকর্মীর সম্মাননা।
৩. ২০১৭ সালে নেত্রকোনা জেলায় ৪টি ক্যাটাগরীর মধ্যে স্থানীয় মৎস্য জাত চাষ ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ্য সম্মাননা।
৪. ২০১৭ সালে সফল যুব আত্মকর্মীর সম্মাননা ‘জাতীয় যুব পুরস্কার ২০১৭’ লাভ।
আত্মকর্ম সংস্থানের মাধ্যমে লিটন চন্দ্র দাস এর সফলতা ও তার খামার দেখার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের অনেক লোক নিয়মিত পরিদর্শনে আসেন। এপর্যন্ত তার খামার পরিদর্শন করা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে-
১. মহা পরিচালক- যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২. উপ পরিচালক- যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, নেত্রকোনা।
৩. সহকারী প্রকল্প পরিচালক-যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর।
৪. জেলা প্রশাসক- নেত্রকোনা জেলা।
৫. উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা- আটপাড়া উপজেলা।
৬. উপজেলা চেয়ারম্যান- আটপাড়া উপজেলা পরিষদ।
৭. চেয়ারম্যান- স্বরমুশিয়া ইউনিয়ন পরিষদ।
৮. আটপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
৯. আটপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
১০. আটপাড়া উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা।
লিটন চন্দ্র দাস’র ভালোলাগা
২০১৬ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষির সম্মাননা পাওয়ার পর মৎস্য চাষে আরও বেশি মনোযোগী হন। তিনি জেলা পর্যায় থেকে স্বীকৃতির জন্য কাজ করতে থাকেন এবং জেলা পর্যায়ে ‘স্থানীয় জাতের মৎস্য ক্যাটাগরী’তে শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষি হিসেবে সম্মাননা পান। জেলা পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভের পর তিনি জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতির জন্য কাজ করতে থাকেন এবং তার সফলতার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সম্মাননা ‘জাতীয় যুব সম্মাননা ২০১৭’ পুরস্কার লাভ করেন, যা’ তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া বলে তিনি জানান। নেত্রকোনা জেলার মধ্যে তিনিই প্রথম জাতীয় যুব উন্নয়ন সম্মাননা পাওয়া ব্যক্তি বলে তিনি খুবই গর্বিত। উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে ভাল কাজের স্বীকৃতি লাভ ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগ কর্তৃক সহযোগিতা লাভ তার সবচেয়ে ভাললাগা।
লিটন দাসের প্রত্যাশা
লিটন দাসের প্রত্যাশা নেত্রকোনাসহ দেশের সব অঞ্চলে যেসকল বেকার যুবকরা রয়েছেন তারাও তার মতো করে চাকরির জন্য সময় নষ্ট না করে আত্ম কর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন কাজে এগিয়ে আসুক। প্রয়োজনে তিনি তাদেরকে পরামর্শ ও কারিগরী সহযোগিতা করবেন। যুবরা আত্মকর্ম সংস্থানের মাধ্যমে নিজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবার তথা দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে তার মত নেত্রকোনা জেলার জন্য আরও জাতীয় পুরস্কার বয়ে নিয়ে এসে নেত্রকোনার গৌরব বৃদ্ধি করুক এই প্রত্যাশা করেন।
লিটন চন্দ্র দাসের ন্যায় হাজারো যুব চাকরির ন্যায় মরিচিকার পেছনে ঘুরে চাকরি না পেয়ে কর্মহীন বেকার বসে সময় অতিবাহিত করছেন। অনেকে যুবক কর্মীহীন থেকে থেকে নৈরাশ্যময় জীবন কাটাচ্ছেন, আসক্ত হয়ে পড়ছেন মাদক নেশায়, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্র বিরোধী বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছেন, যা তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও দেশের জন্য ভয়াবহ হুমকির কারণ হয়ে পড়ছে। এর ফলে মানুষের নিরাপত্তা ও শান্তি বিঘিœত হচ্ছে। অথচ এই যুব সমাজই দেশের সম্পদ। আমাদের দেশের যুব শক্তিকে উৎপাদনে কাজে লাগানো সম্ভব হলে এ দেশ একদিন সত্যিকারের সোনার দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। দেশের সকল যুবদের মধ্যে অনেক লিটন দাস ঘুমিয়ে আছেন, যারা আমাদের বা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সামান্য সহযোগিতা পেলে হয়তো লিটন দাসের মতো জেগে উঠতে পারে। অবদান রাখতে পারে একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে। লিটন চন্দ্র দাসকে অনুসরণ করে সকল যুবরা উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্ত হোন এবং নিজ নিজ কাজে সফলতা পেয়ে পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবে এই প্রত্যাশা করি।