একজন আছিয়া আক্তার আলোকিত জীবনের গল্প
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
কত অজানা জীবনের গল্পই না ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশের আনাচে কানাচে। নীরবে জীবনের সফলতার গল্প তৈরি করে দেশের উন্নয়নের পাটাতনকে করছেন মজবুত। তেমনি একজন গল্পের নারী নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার অরঙ্গবাদ গ্রামের আছিয়া আক্তার (৬০+)। দরিদ্র পরিবারের সন্তান আছিয়া আক্তার কোন রকমে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়শুনার পরই আর পড়তে পারেননি।
১৩ বছর বয়সে বাল্য বিয়ে হয় নেত্রকোনা সদর উপজেলার ফচিকা গ্রামের দরিদ্র আবুল কালামের সাথে। বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি গেলেও অভাব তার পিছু ছাড়েনি। অভাবের মধ্যেই তিনি পাঁচ সন্তানের মা হয়েছেন। স্বামী আবুল কালাম বাড়ি ভিটাসহ ৩০ শতাংশ। তিনি নিজের জমি ছাড়া ও অন্য মানুষের জমি আদি করে যে আয় করেন তা দিয়ে সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে অতি কষ্টের সংসার চালাতে হয় আছিয়া আক্তারকে। স্বামীর আয় রোজগার খুবই কম হওয়ায় এবং স্বামী তাদের ভরণ-পোষণ করতে না পারায় আছিয় আক্তার অন্যের হাসঁ-মুরগি, গরু ও ছাগল বর্গা পালন, অন্যের জমি বর্গা নিয়ে শাক সবজি ও ধান চাষ করেন। তিনি সারাবছর সবজি চাষ করেন। তার বাড়ির চুর্তপাশে শীতকালীন সবজি আছে যেমন: মিষ্টিকুমড়া, ৩ জাতের লাউ, ৮ জাতের সীমের বীজ, ২ জাতের বরবটি, ৫ জাতের আলু রয়েছে। তিনি সারা বছর বিষমুক্ত সবজি চাষ করেন এবং সেই বীজ সংরক্ষণ করেন। এর পাশাপাশি নিজ গ্রাম ছাড়াও অন্য গ্রমের নারীদের মাঝে বীজ বিনিময় করেন।
আছিয়া আক্তার পাড়া প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা নিয়ে কোন রকমে সংসার চালাতে থাকেন এবং সন্তানদের স্কুলে পাঠান। তিনি অল্প শিক্ষত হলেও তিনি জানতেন শিক্ষার কদর। একসময় আছিয়া আক্তার সন্তানদের পড়াশুনা ও সংসারের খরচ চালিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করেও তিনি কখনো ক্লান্ত হননি, হারাননি মনোবল। এভাবেই তার নিরলস পরিশ্রম ও সাধনার কারণেই বর্তমানে তাঁর বড় ছেলে সিলেট বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ে, ছোট ছেলে সরকারি কলেজে অনার্স পড়ে করে এবং ৩য় ছেলে গাড়ী চালাক। দুই মেয়ের মধ্যে তাঁর বড় মেয়ে নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে অনাস মাষ্টাস করেছেন। ছোট মেয়ে নেত্রকোনা সরকারী কলেজে মাষ্টাস পড়ে।
আছিয়া আক্তারের স্বপ্ন ছিল সন্তানদের তিনি মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলবেন এবং তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। কারণ তার ছেলে মেয়েগুলো গ্রামের অন্য মানুষের তুলনায় অন্যরকম। তাদের ব্যবহার, শিক্ষার মানও অন্যরকম। এই প্রসঙ্গে আছিয়া আক্তার বলেন, “আমার সম্পদ কম থাকলেও মনে অনেক সাহস আছে। সবাই বলে তোর মেয়েদের বিয়ে দেস না কেন, আমার বাড়ির সবাই হাসা হাসি করত, সবাই অপমান করত, বিয়ে দেই না দেখে। আজ আমি গর্ববোধ করি আমার দুইটি মেয়েকে নিয়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজে পরিশ্রম করে ৫০ শতাংশ জমি কিনেছি। ঘর ছিল না, এখন একটা বড় করে ঘর করেছি। অর্থ সম্পদ না থাকলেও নিজের জ্ঞানবুদ্ধি কাটিয়ে সংসার চালানো যায়। আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে। কারণ আমার কোন পড়াশোনা ছিল না। তবুও মানুষের মত মানুষ করেছি ছেলেমেয়েদের।’
আছিয়া আক্তার একজন অনুপ্রেরণা নারী। তাকে দেখে যেন আরও অনেক নারী অনুপ্রণীত হতে পারে।