কৃষি তথ্য পাঠাগার
:: রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
উদ্যোগী মো. জাহাঙ্গীর আলম শাহ
“আমি কৃষকের সন্তান, ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি আমার প্রচন্ড আগ্রহ, কৃষি নিয়ে সবসময়ই ভাবি। ভাবতে ভাবতে দেখলাম কৃষি প্রধান দেশ হয়েও আমাদের কৃষকের জন্যে তেমন কোন তথ্যভান্ডার নেই যে সেখানে গিয়ে পরামর্শ নেবো বা সে বিষয়ে পড়ালেখা করবো, তাই পরিণত বয়সে এসে আমার বাড়িটিকেই একটি কৃষি তথ্য পাঠাগারে পরিণত করেছি”। উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার’র প্রতিষ্ঠাতা মো. জাহাঙ্গীর আলম শাহ। যিনি এই কৃষি তথ্য পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন।বর্তমান কৃষির পাশাপাশি তিনি শিক্ষকতা করে কৃষি তথ্য পাঠাগারটির উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
কৃষি তথ্য পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
নওগাঁজেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার ও মান্দা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে নিভৃত পল্লী কালিগ্রামে ২০০৮ সালের ১৮ এপ্রিল নিজ বাড়ির একটি মাটির ঘরে মো. জাহাঙ্গীর শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন। যাত্রার শুরুতে পাঠাগারটির পরিধি একটি ঘরে সীমাবদ্ধ হলেও বর্তমান এটি আরও প্রসারিত হয়েছে। মো. জাহাঙ্গীর শাহ তাঁর পুরো বাড়ি-ঘর এবং বাড়িভিটার সম্পূর্ণ জমিকে এই কৃষি তথ্য পাঠাগারর আওতায় নিয়ে এসেছেন। এই কৃষি তথ্য পাঠাগারকেই তিনি ক্রমান্বয়ে কৃষি যাদু ঘরে রুপান্তরিত করছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা বিলুপ্তপ্রায় দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, আম পাড়ার জালি ও ঠুসি, খেতের ইঁদুর মারার নানা রকমের ফাঁদ, গরুর গলায় বেঁধে দেওয়া ঘুকরা, মুখে দেওয়া টুনা, যাঁতার, পালকির মডেল, বিভিন্ন অঞ্চলের মাছ ধরার ছোটবড় নানা রকমের চাঁই, বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম নিড়ানি, কাস্তে, হাতুড়ি, গাঁইতি, শিকপাই থেকে শুরু করে হরেক রকমের জিনিস রয়েছে এই কৃষি তথ্য পাঠাগারে। এগুলো দেখলে যে কেউ সহজেই সারা দেশের কৃষি ও কৃষকের কথা স্মরণ করবেন, তাঁদের মনে পড়বে অতীতের সমৃদ্ধ কৃষির কথা, লোকায়ত কৃষি চর্চার কথা।
পাঠাগারে রয়েছে কৃষি সংশ্লিষ্ট তথ্য, নানান পুস্তক
পাঠাগারের বাইরে দেয়ালে টাংগানো আছে কৃষকের অভিজ্ঞতা নিয়ে তৈরি করা শস্য ফসলের বারোমাসি পঞ্জিকা।ভার্মী কম্পোস্ট, জৈববালাইসহ কৃষকদের সবকিছু হাতে কলমে করে দেখানোর আয়োজন করে রাখা আছে।একইসাথে নানা ঔষধি ও বৃক্ষলতায় ভরপুর পাঠাগারের চারিধার। কৃষি তথ্য পাঠাগার চত্ত্বরে ঔষধি গুণাবলী সম্পন্ন ২০৪ ধরনের গাছ-গাছালি রয়েছে এবং ৫০ এর অধিক ফলজগাছসহ রয়েছে দুই হাজারের উপরে বই, পুস্তক ও ম্যাগাজিন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর।বই পড়তে এখানে সদস্য ফি বা চাঁদা দিতে হয় না। এখানে কৃষিবিষয়ক বই-পুস্তক ও ম্যাগাজিন ছাড়াও বাস্তবজীবনে কৃষকদের প্রয়োজন যেমনম মৎস্য চাষ, পশুপালন, ভেষজ এমন সব বিষয়ের অনেক বই রয়েছে।কৃষির পাশাপাশি আছে ভ্রমণ, ছোট গল্প, ধাঁধাঁ, চিত্রাংকনের বইসহ প্রশাসন, চিকিৎসা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর।
ব্যবহারিক শিক্ষা
কৃষি তথ্য পাঠাগারে কৃষকদের হাতে কলমে উপকারী পোকা চেনানো হয়, কৃষি বিষয়ক নানা তথ্য উপস্থাপন করা হয়। এই পাঠাগারের পক্ষ থেকে সন্ধ্যাবেলায় নিরক্ষর কৃষকদের সাক্ষরতা অভিযান চালানো হয়। সকালে শিশুদের পাঠাভ্যাসের ব্যবস্থা রয়েছে। কৃষকের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে নিয়মিত স্বাস্থ্য ক্যাম্প এর আয়োজন করা হয়। একই সাথে গ্রামের গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের খাতা কলম দিয়েও সহযোগিতা করা হয়। এখানে কুল চাষে করণীয়, বীজ উৎপাদন কৌশল, ফসলের মাঠ নিয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ওল বীজ বিতরণ ও প্রশিক্ষণ, কলেজ পর্যায়ে বই বিতরণ, মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে কৃষকদের ভূমিকা ও পরিবেশ, মৎস্য চাষে করণীয়, ভেজাল সার চেনার উপায় ও জৈবসার তৈরি নিয়ে কর্মশালা করা হয়৷ সেই সঙ্গে জাতীয় কৃষি দিবসে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য ভালো কৃষক, ভালো হালচাষি, ভালো শ্রমিক, ভালো বীজতলা, ভালো জৈবসার প্রয়োগকারী কৃষকসহ মোট ১৩টি বিভাগে কৃষকদের পুরষ্কৃত করা হয়।স্থানীয় এলাকার কৃষকই শুধু নন অন্য এলাকার কৃষকরাও এই কৃষি তথ্য পাঠাগারের কারণে উপকৃত হচ্ছেন।
একটি তথ্য ভাণ্ডার ও বীজ ব্যাংক
এই কৃষি তথ্য পাঠাগারটি নবীন প্রজন্মের এবং গবেষকদের জন্য শেখার একটি তথ্য ভান্ডারও বটে। প্রতিষ্ঠাতা মো, জাহাঙ্গীর শাহ আম, জামসহ নানা ফলজ গাছ এবং ঔষধি বৃক্ষ চারা ও বীজ মানুষের মাঝে বিতরণ করেন। কৃষি তথ্য পাঠাগারের জন্য তিনি বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন এবং অন্যদের মাঝে বিতরণ করেন যাতে করে এসব হারিয়ে যাওয়া কৃষি সম্পদগুলো টিকে থাকে। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, সুযোগ পেলেই তিনি কৃষি বিষয়ক বই ও পুরাতন হারিয়ে যাওয়া কৃষিসহ বিভিন্ন উপকরণ জোগাড় করেন। এই প্রসঙ্গে মোঃ জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন-“ছোটবেলা থেকেই নানা জায়গা থেকে বিভিন্ন জাতের ফসলের বীজ সংগ্রহ করে এনে তা পরীক্ষা করে ভালো ফসল হলে গ্রামের কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করতাম। সেই ধারাটি আজো অব্যাহত রেখেছি।” এই পাঠাগারের ঔষধি বাগান থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন মানুষ ঔষধি বৃক্ষের ছাল, লতাপাতা বা শিকড় সংগ্রহ করে চিকিৎসা কাজে লাগান।
পুরুষ্কৃত মো. জাহাঙ্গীর আলম শাহ
দিনে দিনে কৃষি তথ্য পাঠাগারটি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা মো. জাহাঙ্গীর আলম শাহ চেষ্টা করেছেন এই পাঠাগারকে আরও সমৃদ্ধ করতে, আরও যুগপোযোগী করতে। এজন্য তিনি কৃষি তথ্য পাঠাগারের জন্য সেমিনার কক্ষ, অতিথিশালা ব্যবস্থাও করেছেন। কৃষি ও কৃষকের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য ভূমিকা রাখার জন্যে মো. জাহাঙ্গীর আলম শাহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরুষ্কার লাভ করেছেন। তিনি রোটারী ইন্টারন্যাশনাল, চ্যানেল আই নিবন্ধ প্রতিযোগিতা পুরুষ্কারসহ নানা পুরুষ্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সর্বশেষ এই বছরের নভেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ব্রি পদকে ভূষিত হয়েছেন।
কৃষি তথ্য পাঠাগারের সেবা ও তথ্য
শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার থেকে যে ধরনের সেবার ও তথ্য পাওয়া যাবে সেগুলো হলো:
- পাঠাগারের জাদুঘর অংশে দেশের প্রাচীন আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের আধুনিক কৃষি উপকরণের সঙ্গে পরিচিত হওয়া সুযোগ রয়েছে।
- হাতে কলমে কৃষি শিক্ষার প্রয়োজনীয় বই, লিফলেট, ম্যাগাজিন ও গবেষণাপত্র পাঠাগারে বসে অধ্যয়ন করার সুযোগ রয়েছে।
- পাঠাগার চত্বরে রয়েছে ২০৪ প্রজাতির ঔষুধি গাছ। ব্যক্তিগত অথবা গবেষণার প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা তা ব্যবহার করতে পারেন।
- দেশের কৃষিবিদ, পরামর্শক, চিকিৎসক, শিক্ষা ও প্রশাসনের প্রয়োজনীয় যোগাযোগের ঠিকানা এবং ফোন নম্বর এখানে সংরক্ষণ করা হয়।
- এলাকাবাসী এখান থেকে কৃষির বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা উপকরণ ও গাছের চারা বিনামূল্যে পেতে পারেন।
- প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে কৃষকরা ২০০ প্রকারের চাষবাসের তথ্যচিত্র দেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন।
- জৈব পদ্ধতিতে চাষবাসের কৌশল শেখানো হয় এবং এই পদ্ধতি ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়।
- কৃষকের প্রয়োজনে যে কোনো গ্রুপের রক্ত সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
- দেশি-বিদেশি গবেষকদের বিনামূল্যে প্রতিষ্ঠানে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারটি সার্বক্ষণিক দেখভালের দায়িত্বরত মো. জাহাঙ্গীর আলমের চাচাতো ভাই লিপটন শাহ বলেন, “মনের আনন্দে আমিও এই পাঠাগারের সাথে মিশে গেছি, সাথে আরো কয়েকজন কৃষক এই পাঠাগারের নানা কাজে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন।” তিনি বলেন, “ এই শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার দেখার জন্য এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক, কৃষকসহ নানা পেশার মানুষ আসেন। অনেক দেশী-বিদেশি গবেষক আসেন এবং এখানে থেকেই তারা কৃষি বিষয়ে গবেষণা করেন।
মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের কৃষি তথ্য পাঠাগারটি দিনে দিনে আরো জপ্রিয়তা লাভ করছে, এখান থেকে স্থানীয় কৃষকসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষক কৃষি বিষয়ে জ্ঞান অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। মো. জাহাঙ্গীর আলম শাহের এই উদ্যোগ অন্য এলাকার মানুষকে উৎসাহিত করুক। বাংলাদেশে প্রতিটি এলাকায় এরকম কৃষি তথ্য পাঠাগার গড়ে উঠুক।