মানব উন্নয়ন ও মানবিক উন্নয়ন
সিলভানুস লামিন
ভূমিকা
মানুষসহ অন্যান্য প্রাণ ও স্পন্দনের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নই হচ্ছে উন্নয়ন। সঙ্গত কারণেই এই উন্নয়ন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ‘মানদণ্ড’ হিসেবে বিবেচনা করে না। এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক তথা আত্মিক উন্নয়নকে সমান গুরুত্ব দেয়। এই উন্নয়নকে আমরা দু’টি ভাগে করতে পারি। এক: মানব উন্নয়ন এবং দুই: মানবিক উন্নয়ন। খুব কাছাকাছি দু’টি শব্দদ্বয়। দু’টি শব্দই মানুষের উন্নয়নের কথা বলে। একটি মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়ন এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় (অর্থনৈতিক) একটি জীবিকার কথা বলে। অন্যটি মানুষের জীবনের ভেতরকার তথা আত্মিক উন্নয়নের কথা বলে যেখানের মানুষের ব্যবহার, আচরণ, সহনশীলতা ও ক্ষমাশীলতার সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের জীবনে সার্বিক উন্নয়ন সাধন করতে হলে এ দু’টি উন্নয়নকে অবশ্যই জোরদার করতে হবে। মানব উন্নয়ন সূচক এর কথা আমরা প্রায়ই শুনি। কোন দেশ কতটা উন্নতি লাভ করেছে সেটা এখন পরিমাপ করা হয় মানব উন্নয়ন সূচকে বা Human development Index (HDI) দিয়ে। সঙ্গত কারণেই আমাদের জানা দরকার মানব উন্নয়ন বলতে কী বুঝায়? ১৯৯০ সালের দিকে প্রথমবারের মতো মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি নতুন এ্যাপ্রোচ বা দৃষ্টিভঙ্গি আগমন লাভ করে এই প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয়, মানুষের জীবনের সমৃদ্ধি সম্প্রসারণ বা বৃদ্ধি করাই মানব উন্নয়ন। এই উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে: ১. মানুষ, ২. তাদের সুযোগ এবং ৩. তাদের পছন্দ। অন্যদিকে মানবিক উন্নয়ন বলতে মানুষের আত্মিক, নৈতিক উন্নয়নকে বুঝায়। এই উন্নয়ন মূলত মানুষের আচরণ ও ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে। একজন মানুষ ‘মানুষ’ হিসেবে সে কতটা পরিপক্ক সেটা বুঝা যায় এই মানবিক উন্নয়নের মাধ্যমে।
মানব উন্নয়ন
পূর্বেই বলা হয়েছে, মানুষের জীবনের সমৃদ্ধি বা Richness সম্প্রসারণ বা বৃদ্ধি করাই মানব উন্নয়ন। এই উন্নয়নে মানুষের ওপর জোর দেয় বেশি; পুরো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা অগ্রগতির ওপর নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের জীবনকে আরও উন্নত করা, সহজ করা এবং সমৃদ্ধ করার ওপর জোর দেয়। এখানে মানুষের জন্য ‘সুযোগ’ ও ‘পরিবেশ’ তৈরি করা হয় এবং এই ‘সুযোগ’ ও ‘পরিবেশ’ পাওয়ার পর সেই মানুষ যাতে নিজে ‘পছন্দ’ বাছাই করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়। অনেকে মনে করেন দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সে দেশের মানুষের জীবন উন্নতি হবে, অর্থনীতির সমৃদ্ধির ফসল সবাই ভোগ করতে পারে। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি মনে করে অর্থনীতির সমৃদ্ধি বা অগ্রগতি হলেও সেটা গ্যারান্টি দেয় না যে, দেশের সব মানুষ সেই অগ্রগতি ও সুফল ভোগ করতে পারে বা সেই সুফলে লাভবান হবে। মানব উন্নয়ন মানুষকে তাদের পছন্দের এবং প্রত্যাশিত জীবন পরিচালনা করার সুযোগ দেয়; যে জীবনকে তারা সম্মান করে এবং এর উন্নয়নে মনোযোগী হয়। মানব উন্নয়ন মানুষের সক্ষমতা উন্নয়ন করে এবং এই সক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, একজন আদিবাসী শিশুকে আমরা শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করে তুলতে পারি কিন্তু সেই দক্ষতার কোন মূল্য থাকবে না তাকে যদি চাকুরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত করি কিংবা সেই চাকুরির বাজারে সে যদি সেই দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ না পায়। মানব উন্নয়নের তিনটি মূল স্তম্ভ রয়েছে: ১. একটি দীর্ঘ, স্বাস্থ্যসম্মত ও সৃজনশীল জীবন পরিচালনা, ২. তথ্যসমৃদ্ধ ও দক্ষতাপূর্ণ জীবন পরিচালনা এবং ৩. একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সুখী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের ওপর প্রবেশাধিকার থাকা। মানুষ যদি এই তিনটি প্রয়োজনীয় বিষয় লাভ করে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সে যে জীবন প্রত্যাশা করে সেই জীবনটা পরিচালনা করতে পারে। তাই বলা হয়, মানব উন্নয়ন মানুষকে বিভিন্ন ‘সুযোগ’ দেয় এবং তাকে তার ‘পছন্দ’ লাভ করতে সহায়তা করে।
মানবিক উন্নয়ন
মানুষ বেশির ভাগ সময়ে উন্নয়ন বলতেই তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়াকে বুঝে থাকেন। ফলশ্রুতিতে, তারা যেকোন কাজ করতে পিছপা হন না। এই ‘যেকোন কাজ’ হতে পারে প্রাণ ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করা, আমাদের মতো মানুষকে শোষণ, নিপীড়ন ও প্রতারণা করা। নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতা জাহিরের জন্য মানুষ অনেকসময় অন্যকে মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। তাই সার্বিক উন্নয়ন সাধনের জন্য মানবিক উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া উচিত। মানবিক উন্নয়নের একেকটি রূপ হতে পারে অন্যের সাথে আমাদের মিথষ্ক্রিয়ায়, আচার, আচরণ ও ব্যবহার আরও সংবেদনশীল করা, আরও যত্নশীল ও দায়িত্বশীল করে তোলা। আমাদের কথা, আচরণ মানুষকে কষ্ট দেয় কি না, আমরা আমার মতো মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করি কি না, কিংবা মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণ ও প্রকৃতিকে ভালোবাসার চোখে দেখি কি না; সেটি পর্যালোচনা করে নিজের আচরণ, ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রতিটি মানুষের ভেতরে একটি ভালো মন আছে। তবে অনেক সময় মানুষ সেটি ভুলে গিয়ে অন্যের সাথে হিংস্র আচরণ করে। অন্যের মতামত, কথা, আচরণ, আচরণ বা ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল হয় না। মানবিক উন্নয়ন সাধিত হলে মানুষ অমায়িক হয়, সহনশীল হয়, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং সর্বোপরি সবাইকে আপন করে নেয়। তাই শুধু মানব উন্নয়ন নয়; মানবিক উন্নয়নের প্রতিও আমাদের সমান মনোযোগ ও সমান গুরুত্ব থাকা উচিত। কারণ আমাদের ভূর্তপূর্ব মানব উন্নয়ন সাধিত হলেও যদি আমরা মানবিক উন্নয়নে পিছিয়ে থাকি তাহলে সেই উন্নয়নের কোন গুরুত্ব বহন করে না কারও কাছে।