কৃষাণীদের উদ্যোগে গ্রামে অনুষ্ঠিত হল বাহারী গ্রামীণ পিঠার উৎসব

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

উৎসব সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে হাওর-বাওর, নদী-নালা, জল-জলাশয়, পুকুর, বিল, বনাঞ্চল নিয়ে ভৌগলিকভাবেই কৃষি সংস্কৃতির এক উর্বর ভূমি নেত্রকোণা। নেত্রকাণার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে লোক কবি কঙ্ক, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত পালাকার মনসুর বয়াতি, কবিয়াল বিজয় আচার্য, মদন মোহন আচার্য,“ময়মনসিংহ গীতিকার” সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে, ‘রবীন্দ্র গবেষক’ শৈলজা রঞ্জন মজুমদার, মরমী সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ, রশিদ উদ্দীন, উকিল মুন্সী, কমরেড মনি সিংহ, হাজং মাতা রানী রাসমনি, লেখক ও বুদ্ধিজীবি যতীন সরকার, সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজসহ যুগে যুগে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

pitha

কিন্তু গ্রামীণ সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমন- বাউল গান, জারি গান, গ্রামীণ খেলা, পার্বণ, গ্রামীণ মেলা, পিঠা উৎসব এসব কিছু থেকে মানুষ আজ বিচ্ছিন্ন প্রায়। বিশেষভাবে নতুন প্রজন্ম গ্রাম বাংলার প্রকৃত সংস্কৃতি সম্পর্কে খবই উদাসীন। নতুন প্রজন্ম পাশ্চাত্য ও ভিনদেশী সংস্কৃতিতে আসক্ত। নিজস্ব গ্রামীণ সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সাথে মানুষের দূরত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। চর্চার অভাবে দিন দিন সংস্কৃতি বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ায় মানুষের মধ্যে একাকীত্ব বাসা বাঁধছে, মানুষ পারস্পারিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। মানুষে-মানুষে পারস্পারিক সংঘাত রোধ করতে এবং পারস্পারিক সহযোগিতা ও পারস্পারিক আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধিতে এখন প্রয়োজন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার। গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এলাকার সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। গড়ে উঠে পারস্পারিক আন্তঃনির্ভরশীলতার।

নেত্রকোনা সদর উপজেলায় মদনপুর ইউনিয়নের মনাং গ্রামের ‘কুসমকলি কৃষাণী সংগঠন’ প্রায় এক বছর যাবত গ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণসহ বিভিন্ন ধরণের উন্নয়মূলক কাজ করে আসছে। সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামীণ সংস্কৃতি রক্ষায় পিঠা উৎসবে গ্রামীণ গীত, কিচ্চা ও খেলাধূলার আয়োজন করে। সংগঠনের সদস্যরা দল বেঁধে ঢেঁকিতে চাল গুড়ো করে পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় পিঠা তৈরি করে। তিন দিন আগে থেকে সংগঠনের সকল সদস্য পিঠা উৎসবের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে প্রবীণ নারীরা পালাক্রমে গীত পরিবেশন ও গ্রামীণ কিচ্চা শোনায়। পিঠার উৎসবে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার শিশুসহ প্রবীণ ও নবীনরা অংশগ্রহণ করে নিজেদের তৈরিকৃত বৈচিত্র্যময় পিঠা প্রদর্শন করে। অংশগ্রহণকারীরা পিঠার উপকরণ ও তৈরি পদ্ধতি সম্পর্কে পরস্পরের সাথে সহভাগিতা করে।

pitha-1

পিঠা উৎসবে প্রদর্শিত পিঠাগুলোর মধ্যে ছিল- চইপিঠা, পুলিপিঠা, ফুল পিঠা, দুধপুলি, চালের সেমাই, কলাপিঠা, কলার সেমাই, চেপাপিঠা, চিতই, ভাপা, তারাপিঠা, বিস্কুট পিঠা, নকশী পিঠা, পাতা পাপড়া, জালি পাপড়া, সন্দেশ, ও লাড়–সহ হরেক রকমের পিঠা। প্রদর্শনী চলাকালীন সময়ে অংশগ্রহণকারী নারীরা বাঙালির গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এসব পিঠার ব্যবহার ও তৈরির মৌসুম সম্পর্কে আলোচনা করেন। আলোচনা থেকে দেখা যায়, বাঙালির গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এর বহুবিধ ব্যবহার ও গুরুত্ব রয়েছে। পিঠা উৎসবে পিঠা প্রদর্শনী ও আলোচনা ছাড়াও ছিল বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে পরস্পরকে বল ছোড়া, ঝুড়িতে বল নিক্ষেপ, গ্রামীণ গীত, প্রবীণ নারীদের যেমন খুশী তেমন সাজো অভিনয়। প্রবীণ অংগ্রহণকারীরা অনুষ্ঠানে গ্রামীণ গীত পরিবেশন করেন। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন কুসমকলি কৃষাণী সংগঠনের সভা প্রধান মমতা আক্তার।

কৃষাণী মমতা আক্তার গ্রামীণ পিঠার উৎসব আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “এক সময় গ্রামীণ পিঠা উৎসব ছিল বাংলার ঐতিহ্য। একসময় গ্রামের সকলে মিলে একত্রে চালের গুঁড়ি কুটা থেকে শুরু করে বৈচিত্র্যময় পিঠা তৈরি করতো। বিশেষভাবে শীতের মৌসুমের শুরুতে গ্রামে ঘরে ঘরে চালের গুঁড়ি কুটা ও পিঠা তৈরির ধুম লেগে যেত।” তিনি আরও বলেন, “ঘরে ঘরে মেয়ের জামাই ও তার আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে বাহারী পিঠা, পায়েস ও মিঠাই খাওয়ানো হতো। আত্মীয়স্বজনের পদচারণায় প্রত্যেক ঘর ভরে যেত।” তিনি বলেন, “কালের বিবর্তনে এসব বাহারী নকশা ও সুস্বাদু পিঠাগুলো আজ বিলপ্তির পথে। তাই পিঠা উৎসবের মাধ্যমে বাহারী পিঠাগুলোর সাথে নতুন প্রজন্মের পরিচিত করা এবং গ্রামের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের পারস্পারিক উন্নয়ন ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই পিঠা উৎসব আয়েজন করা হয়েছে।”

কৃষাণী সালমা আক্তার বলেন, ‘‘আগে আমরা নতুন জামাই, বেয়াইন-বেওয়াই ও আত্মীয়স্বজন আসলে সকালে নাস্তা দিতাম পিঠা দিয়ে। আমরা আট-দশ জন নারী মিলে সারা রাত পিঠা বানাইতাম, গীত গাইতাম ও গুন গুন করে গান গাইতাম, একজন আরেক জনের সাথে সুখ দুঃখ নিয়ে আলোচনা করতাম। এখন আর সেরকম কিছু হয় না। তাই কুসুমকলি সংগঠনের সদস্যরা মিলে গ্রামীণ পিঠা উৎসবের আয়োজন করেছি।’’

pitha-2

পিঠা উৎসবসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পার্বণ সম্মিলিতভাবে উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চা হতো, পারস্পারিক সম্পর্ক ও পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত আরো শক্ত হত। অনেক অভাবের মাঝেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানসিক শান্তি পেত। গ্রামে তেমন অশান্তি ও সংঘাত ছিলনা বললেই চলে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের উন্নয়ন, পারস্পারিক সহযোগিতা ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পারস্পারিক বন্ধন টেকসই ও শক্তিশালীকরণে তাই এখন প্রয়োজন গ্রামীণ সংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধি করা।

happy wheels 2

Comments