পরিবেশ-প্রতিবেশ উন্নয়নে উদ্ভিদ ও প্রাণীর গুরুত্ব 
সিলভানুস লামিন
আজ বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে Recovering key species for ecosystem restoration’ (সমৃদ্ধ প্রতিবেশ ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতিগুলোকে ফিরিয়ে আনি) । ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। মূলত প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুরক্ষিত এবং বিশ্বের সব ধরনের প্রাণ ও উদ্ভিদ সম্পদকে (Flora and Fauna) রক্ষায় জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্যই জাতিসংঘ প্রতিবছর ৩ মার্চ এই দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়। এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রাণী ও উদ্ভিদ আমাদের বাস্তসংস্থান ও প্রতিবেশকে অনবরত সুরক্ষা করে গেছে। আমাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ অবদান রেখে চলেছে। মূলত বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের কল্যাণেই মানবজাতি আজও ভালো আছে, উন্নতি হচ্ছে এবং সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। তাই এসব বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সংরক্ষণ করার আমাদের সবার দায়িত্ব।
তবে দুঃখের সাথেই বলতে হয়, দিনকে দিন বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। কোন কোন উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে আবার কোনটা পুরোপুরিই বিলুপ্ত হয়েছে। একটি প্রতিবেদন মতে, বিশ্বে ৮০০০ প্রজাতির বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ আজ মহা সঙ্কটাপন্ন তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ হাজার বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। অন্যদিকে উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর আইইউসিএন ও বন অধিদপ্তর যে লাল তালিকা করেছে, তাতে ১৬১টি প্রজাতি হুমকির মুখে। এরা মহাবিপন্ন, বিপন্ন কিংবা সংকটাপন্ন। আর এই চার দলের প্রাণীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে স্তন্যপায়ীর অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্তন্যপায়ী বিলুপ্তির হুমকির মধ্যে রয়েছে (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ, ৩ মার্চ, ২০২২)।
আমরা জানি আমাদের দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা উপাদানের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। এসব জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক সম্পদের নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা নির্ভর করেন নদ-নদীর মাছের ওপর, বনাঞ্চলের গাছের ওপর এবং তারা নির্ভর করছেন বনাঞ্চলের ফলমূল, শাকসবজির। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে দিন দিন মানুষ অধিক হারে প্রাকৃতিক উপাদান আহরণ করছে। ফলে এসব প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকা প্রাণীরা খাদ্যের সংকটে পড়ছে। আমরা জানি যে, একটি বন্য প্রাণীর প্রধান চাহিদা উপযুক্ত বাসস্থান ও পর্যাপ্ত খাদ্য। তারা অনেকে বাসস্থান হারিয়েছে, কারও সংকুচিত হয়েছে, অনেকের বাসস্থান কোনো রকমে টিকে থাকলেও অবক্ষয় হয়েছে মারাত্মকভাবে। ফলে বাস্তুহারা হয়েছে নানা প্রাণী, খাদ্যের জোগান হ্রাস পেয়েছে কারও কারও। অন্যদিকে কিছু কিছু উন্নয়ন উদ্যোগ ব্যাপকভাবে বন উজাড় ও প্রাণী ও উদ্ভিদের বিপন্নতার জন্য্ দায়ি। বন্য প্রাণীর
জীববৈচিত্র্য, বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধানকল্পে ২০১২ সালে বন্য প্রাণী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে শুধু আইন প্রয়োগ করে অপরাধ ঠেকানো মুশকিল। তবে সঠিক প্রয়োগ হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব নয়। দেশের বন্য প্রাণী রক্ষায় বন্য প্রাণী ২০১২ আইনটি একটি ভালো রক্ষাকবচ। তাই এই আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা খুব জরুরি। মাঠপর্যায়ে এ আইনের প্রয়োগ বর্তমানে লক্ষ্য করা গেছে। তবে এই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ সুরক্ষায় জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
বারসিক একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করে আসছে। সংগঠনটি কর্মএলাকার জনগোষ্ঠীর মাঝে অচাষকৃত উদ্ভিদের গুরুত্ব, প্রাণসম্পদের প্রয়োজনীয়তা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় তাদের সম্পৃক্ত করে নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বারসিক মনে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে একটি আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে ও শক্তিশালী করতে হলে বন উজাড়, শুধুমাত্র একক প্রজাতির উদ্ভিদ চাষসহ নানান পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড পরিহার করতে হবে। এছাড়া বন সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ রক্ষায় সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পরিবেশ ও বন ব্যবস্থাপনায় তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং লোকায়ত জ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে।